কারাগারের ভেতরের ভয়ংকর কাহিনী

প্রকাশিত: ২:৪৬ অপরাহ্ণ, মে ৫, ২০১৬

প্রভাতবেলা প্রতিবেদক:  কেন্দ্রীয় কারাগারের এক কোনায় বসে কাঁদছিলেন গোলাম মোহাম্মদ। তিনি নারায়ণগঞ্জের স্থায়ী বাসিন্দা। তার বড় ছেলে একটি অপহরণ মামলায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি। প্রতি সপ্তাহে ছেলের থাকার জন্য কারাগারে তাকে পাঠাতে হয় সাড়ে ৩ হাজার টাকা। কিন্তু দুই সপ্তাহ ধরে সেই টাকা দিতে না পারায় ছেলের ওয়ার্ড পরিবর্তন করে দিয়েছে ম্যাড কয়েদি নাছির ও এমদাদ। যে ওয়ার্ডে তাকে রাখা হয় সেখানে থাকতে অনেক কষ্ট। ছেলের সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি জানতে পেরে বাইরে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন আর্থিক অনটনে থাকা এই বাবা।–যুগান্তর।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার নেছার আলম বলেন, কয়েদি নাছির ও এমদাদের বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযোগ পাওয়ার পর কারা বিধি অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। এমনকি তাদের এ কারাগার থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এ ধরনের অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে পাওয়া যাবে তাদের ব্যাপারে কোনো ছাড় দেয়া হবে না।
তিনি বলেন, ‘চোরচোট্টা, খুনি, মাতাল আর অপরাধী নিয়ে আমার বসবাস। ভেতরে যারা আছে তার সবগুলোই অপরাধী! সে বিষয়টিও আমার মাথায় রাখতে হয়।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে জেলার বলেন, ‘২ হাজার ৬৮২ জনের স্থলে বর্তমানে কম-বেশি প্রতিদিন গড়ে রাখা হচ্ছে প্রায় ১০ হাজার বন্দিকে। অস্বাভাবিক এই বন্দি রাখার কারণে সব বন্দিই একটু আরাম-আয়েশের সন্ধান করেন। আর আর্থিকভাবে সচ্ছল বন্দিদের আবদার মেটাতে টাকা আদায়ে কয়েদিরা নানা কৌশল করে তা অস্বীকার করা যাবে না।’
তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, শুধু গোলাম মোহাম্মদের মতো ভুক্তভোগীর সংখ্যা একজন নয়, কারাগারে থাকা প্রত্যেকের পরিবার এ ঘুষ ও চাঁদাবাজির শিকার। অপরদিকে এভাবে ঘুষ আদায়কারী ম্যাড কয়েদি নাছির ও এমদাদও দু’জন নয়, কেন্দ্রীয় কারাগারসহ প্রতিটি কারাগারে এদের সংখ্যা কয়েকশ’। যারা বড় কর্তাদের টাকা দিয়ে আয়ের মেশিনে পরিণত হয়েছে। তাই কয়েদি হয়েও অনেকে কারাগারে বসে চাকরির মতো দিব্বি প্রতি মাসে মোটা অংকের আয়-উপার্জন করছেন।
ফাইলেই জিম্মি : একজন কারাবন্দি কারাগারে গিয়ে যে শব্দটির সঙ্গে আগে পরিচিত হন তার নামই ‘ফাইল’। প্রত্যেক কারাগারেই বন্দিদের মুখে এ শব্দটির প্রচলন খুবই বেশি। বিশেষ করে প্রচণ্ড গরমে এ ফাইলই হচ্ছে কারাবন্দিদের আতংক। আমদানি ওয়ার্ডে বন্দিদের ইলিশের ফাইল করার মতো সোজাসুজিভাবে শুইয়ে রাখার কারণে ফাইল শব্দটির প্রচলন হয়েছে।
একজন কারাবন্দির দুর্বিষহ জীবন এখান থেকেই শুরু। দেশের সব ক’টি কারাগারেই রয়েছে এ ফাইলের প্রচলন। কারণ ফাইলে ফেলেই কারাবন্দিদের জিম্মি করে আদায় করা হয় মোটা অংকের টাকা।
একজন বন্দি এ বিষয়ে বলেন, ‘আমদানি ওয়ার্ডে আসা একজন বন্দির প্রথম রাতের অভিজ্ঞতা হয় সবচেয়ে বড় ভয়ংকর। ম্যাড যখন নতুন বন্দিকে শুইয়ে দিয়ে দুই বন্দির মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গা পিঠে হাঁটু দিয়ে বন্ধ করার চেষ্টা করেন তখনই সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে যায়।
তিনি বলেন, ‘এই অসহ্য কষ্ট ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। মূলত এই ওয়ার্ডে যাতে কোনো বন্দি থাকতে ইচ্ছুক না হন সে কারণেই প্রথম রাতেই তাকে সাইজ করা হয়। পরদিন কত টাকার বিনিময়ে কোন আসামি কোন ধরনের ওয়ার্ডে যাবে তা ঠিক করা হয়।’
ভয়ংকর যারা : ভুক্তভোগী বন্দিদের পাঠানো তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী সবচেয়ে অত্যাচারী সিও ম্যাড হিসেবে যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে তারা হলেন আমদানি ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা সাকু মেম্বার, মনিহার ৫-এর দায়িত্বে থাকা সিও ম্যাড মেহেদি, মনিহার ৪-এ সিও ম্যাড বাবু ও মাসুদ, মনিহার ২-এ মাসুম, মনিহার ৬-এ সিও ম্যাড জাহাঙ্গীর ও শহিদ, মান্নান, আক্তার ও কানু, পদ্মা ভবনের দায়িত্বে থাকা জল্লাদ শাহজাহান, হারুন ও মিজান। এরা সবাই সিও ম্যাড। মধুমতি ভবন দালান নামে পরিচিত। এই ভবনেও ওয়ার্ড রয়েছে একাধিক।
এসব সিও ম্যাডরা কারা কর্তৃপক্ষকে কোনো পাত্তাই দেয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। কারণ কারারক্ষী থেকে শুরু করে শীর্ষ কর্মকর্তা পর্যন্ত প্রত্যেকেই টাকার বিনিময়ে ওয়ার্ড বরাদ্দ দিয়ে বন্দিদের ওপর স্টিম রোলার চালানোর লাইসেন্স দিয়েছেন। এই লাইসেন্স পেয়েই প্রত্যেক বন্দির কাছ থেকে টাকা আদায়ের কাজটি এসব সিও ম্যাডরাই করে থাকেন। তাই কারাবন্দিদের দৃষ্টিতে এরা সবাই ভয়ংকর। উল্লেখ্য, যেসব কয়েদির সাজার মেয়াদ শেষ পর্যায়ে তাদের কারাগারের ভাষায় বলা হয় সিও ম্যাড।
প্রসঙ্গত, দেশের বিভিন্ন নদী ও ফুলের নামানুসারে কারাগারের ভবন ও সেলের নামকরণ করা হয়। যেমন- পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা, মধুমতি, রূপসা, মনিহার, শাপলা, বনফুল, বকুল, হাসনাহেনা, জলসিঁড়ি, কাঁঠালীচাপা, মাধবীলতা, চম্পাকলি, জুঁই, গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা। মহিলা ওয়ার্ড জবা, করবী, সিলভিয়া, কৃষ্ণচূড়া, গোলাপ। কারাগারের অন্যতম বন্দিশালা বলা হয় এসব সেলকে। টাকা আদায়ের সুবিধার জন্যে সামর্থ্যবান বন্দিদের আলাদা ওয়ার্ডে রাখা হয়। সেসব ওয়ার্ডের ম্যাডরা কারা কর্তৃপক্ষের হাতে এক লাখ টাকা অগ্রিম দিয়ে নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিয়ে থাকেন। ওয়ার্ড বরাদ্দ পেতে কয়েদিদের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকলে দর কষাকষির এই হার ডাবল হয়ে যায়।
বাড়তি আয়ের উৎস : ৯০ সেলের বাসিন্দা একজন বন্দি বলেন, এই সেলে থাকা বন্দির কোনো আত্মীয়-স্বজন দেখা করতে এলে প্রথম সাক্ষাতেই গুনতে হয় ৬ হাজার টাকা। ১০ সেল, ১৪ সেল, ২৭ সেল, ৬ সেল, শাপলা সেলেও একই অবস্থা। বন্দিরা ওয়ার্ড পরিবর্তন করতে চাইলে কমপক্ষে ৫ হাজার টাকা দিতে হয়। আর সেল পরিবর্তন করতে হলে গুনতে হয় ১০ হাজার টাকা। আর কোনো বন্দি যদি অপরাধ করে তাহলে টাকা কামানোর মাত্রা আরও বেড়ে যায়।
এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কোনো বন্দি অপরাধ করলে বা অভিযুক্ত হলে সিও ম্যাডের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা এবং উপরে এক লাখ টাকা আদায় করা হয়। টাকা আদায় না হওয়া পর্যন্ত অভিযুক্তকে আমদানি ওয়ার্ডের ফাইলে ফেলে রাখা হয়।
রক্ষাকবচ হাসপাতাল : ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছে ১৭২ বেডের একটি হাসপাতাল। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হাজতি ও কয়েদিদের মধ্যে যারা প্রকৃত রোগী তাদের সুচিকিৎসায় হাসপাতালটি তেমন কোনো কাজে আসে না। বিশেষ করে যাদের হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেয়া প্রয়োজন তাদের অনেকে সময়মতো এই সেবা পান না। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে হাসপাতালের বেশিরভাগ চলে যায় প্রভাবশালী ও ধনী বন্দিদের দখলে।
এ বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষ খবরদারি করার চেষ্টা করলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ভালো বন্দিকে নানান রোগে আক্রান্তের কথা বলে ব্যবস্থাপত্র দেন। অভিযোগ করা হয়েছে, এই সুযোগে সিট বরাদ্দ দিয়ে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
সূত্র জানায়, এখানে সিট বাণিজ্য এমন পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হয়েছে যে, হাসপাতালে কোনো রোগী থাকতে পারে না। হাসপাতালের প্রতিটি বেড মাসিক ১৫ হাজার টাকা দরে রীতিমতো ভাড়া দেয়া হয়। অপরদিকে ওষুধপথ্যের ক্ষেত্রেও বিরাজ করছে নৈরাজ্যকর এক পরিস্থিতি। পাতলা পায়খানা, জ্বর, পেটব্যথা এমনকি ডায়াবেটিসের জন্যও দেয়া হয় একই ওষুধ। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালে আসা বেশিরভাগ মূল্যবান ওষুধ বাইরে বিক্রি করে দেয়া হয়।
এ বিষয়ে একজন বন্দি এ প্রতিবেদকের কাছে পাঠানো চিরকুটে উল্লেখ করেন, ‘কারাবন্দিদের এই ভোগান্তির বিষয় বলে শেষ করা যাবে না। অন্তর ভাষায় উপলব্ধি করে নিবেন।’ কোনো কোনো সময় ওয়ার্ডের ইনচার্জদের বিভিন্ন অভিযোগে কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়। কিন্তু সপ্তাহ না যেতেই টাকা কামানোর ধান্ধা নিয়ে এরা চিকিৎসার কথা বলে আবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চলে আসে। কোনো রোগব্যাধি না থাকলেও কারা হাসপাতালের চিকিৎসককে টাকা দিয়ে রোগী সেজে থাকার চেষ্টা করেন। এসব ম্যাডই কারাগারে বন্দিদের অত্যাচার-নির্যাতন বেশি করে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় কারাগারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, হাসপাতালের বিষয়ে উত্থাপিত এসব অভিযোগ অনেকাংশে সত্য। কিন্তু একজন চিকিৎসক যখন তার নীতি এবং আদর্শ সব পায়ে ঠেলে সুস্থ-সবল বন্দিকে অসুস্থ হিসেবে ব্যবস্থাপত্র দেন তখন কারা কর্তৃপক্ষের কী করার আছে?
তিনি বলেন, এ নিয়ে চিকিৎসকের সঙ্গে জেলারের বাকবিতণ্ডার মতো ঘটনাও ঘটেছে। তবে বেশি জোর জবরদস্তি করা হলে চিকিৎসকরা বলেন, ‘আপনারা লিখিত দিয়ে বন্দিকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যান। বন্দির কিছু হলে দায়-দায়িত্ব কারা কর্তৃপক্ষের।’
ওই কারা কর্মকর্তা বলেন, আসলে ঝামেলা এড়াতেই শেষ পর্যন্ত চিকিৎসকের দেয়া সিদ্ধান্তই মেনে নিতে হয়।
একাধিক বন্দির দেয়া চাঁদাবাজির সত্যতা স্বীকার করেন রাজধানীর খিলগাঁওয়ের মনিরুল ইসলাম নামের এক অভিভাবক। তিনি প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ করে বলেন, তার ছেলেকে একটি মামলায় সম্প্রতি কারাগারে যেতে হয়। ছেলেকে দেখতে গেলে তাকে জানানো হয় প্রতি সপ্তাহে সাড়ে তিন হাজার টাকা পরিশোধ করতে পারলেই তার সন্তান ভালো থাকবে। আর টাকা না দিলে জায়গা হবে ফাইলে।
তিনি বলেন, তারপর হঠাৎ একদিন কারাগারের দুই কারারক্ষী তার বাসায় হাজির হন টাকার জন্য। পরে ছেলের জামিন হয়ে যাওয়ায় তিনি আর কোনো টাকা পরিশোধ করেননি।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।

সর্বশেষ সংবাদ