“নির্মলেন্দু গুণদা আমি মেট্রিক পাশ করেছি”

প্রকাশিত: ২:৩৩ অপরাহ্ণ, জুন ২১, ২০১৮

 

 

 

      মাকসুদা লিসা

“তোমার পায়ের নিচে আমিও অমর হব,

আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও।

এই নাও আমার যৌতুক, এক-বুক রক্তের প্রতিজ্ঞা।
ধুয়েছি অস্থির আত্মা শ্রাবণের জলে, আমিও প্লাবন হব,
শুধু চন্দনচর্চিত হাত একবার বোলাও কপালে।
আমি জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে উড়াব গাণ্ডীব,
তোমার পায়ের কাছে নামাব পাহাড়” ।

 

 

নির্মলেন্দু গুণ দা ঠিক একই রকম আছেন। বদলাননি একটুও। অবিকল সেই অবয়ব। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। সেই ঝুল পাঞ্জাবী। সেই লম্বা বিশাল শরীরের মানুষটি।

 

গুণদা কে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে চেনা যায়। চেনা যায় তার মুখয়বের বৈশিষ্টে। সৌন্দর্যে। সেই লম্বা দাঁড়ি গোঁফ। যা অনেককাল তার চেহারাটাকে স্মৃতির ক্যানভাসে আটকে রেখেছে।

সেই গুণদা। আমার কিশোরী বয়সের অনুপ্রেরণা। যার একটি কথা আজও আমাকে লড়তে শেখায়। পড়তে শেখায়। শেখায় কাব্যিকতার জগতে প্রবেশ করার মন্ত্র।

 

নির্মলেন্দু গুণ আমার জীবনে প্রথম দেখা কোন মহাপুরুষ। বিদ্বান। গুণীজন। কবি। লেখক, সাংবাদিক।

 

একদা গুণদা আমাদের বাড়ীতে এসেছিলেন। তখন আমি সবে স্কুলে যাওয়া-আসা শুরু করেছি। কোন এক জমিজমা সংক্রান্ত বিষয়ে। আমার বাবা’র কাছে এসেছিলেন। স্মৃতির পাতায় সবকিছু ঝাপসা।। যতদূর মনে পড়ে, তার কোন আত্মিয় বা পরিচিতজন আমাদের এলাকায় কোন বাড়ী বা জমী নিয়ে ঝামেলায় পড়েছিলেন। আমার বাবা এলাকার মুরব্বি। সাবেক মেম্বার। তিনবার নির্বাচন করে পাশ করেছেন। শেষবার চেয়ারম্যান ছিলেন।

 

তাছাড়া এলাকার সব জায়গা সম্পতি তার পরিবারেরই (ভাই,বোন, চাচা) ছিল। বিশাল জমিদারী। পুরো এলাকায় কোন জায়গা জমি বিক্রি হলে তার দ্বারস্থ হতে হতো সবাইকে। জমির দাগ নাম্বার, খাজনা, মৌজা, ইত্যাদিই আরো অনেক কিছুর সমাধান তার কাছে।

আমাদের সেসময় পড়ার ঘর ছিল দুটি। একটা রাস্তার ঠিক পাশে। চেয়ার টেবিল দিয়ে ঠাসা। মুল বাড়ী থেকে একটু দূরে।

আরও পড়ুন  সৌদিআরবে বাপ-ছেলে একসাথে ধর্ষণ করে

সেই সময় আমাদের বাসায় লজিং মাষ্টার সিস্টেম ছিল। প্রয়োজনের অতিরিক্ত দু’জন মাষ্টার আমার বড় ভাই-বোনদেরকে পড়াতেন। থাকতেন। নিজেরা ভবিষ্যৎ গড়তেন। আমি ছিলাম ছোটদের দলে।

 

নির্মলেন্দু গুণদার সঙ্গে আরোও দুই তিনজন এসেছিলেন। সেই জমিজমা কোন বিষয় নিয়ে আলোচনায় নিয়ে। সন্ধ্যায় পাঠ চলছিল তখন। শুনেছিলাম সে বড় কবি।

সেই কিশোরি বয়সে আমাকে অনেকেই আদর করতেন। মায়া করতেন। ছোট বাচ্চাদের যেভাবে মানুষ কাছে ডাকে। স্নেহমাখা সুরে। ঠিক সেই ভালবাসা। আমার মনে আছে। দাদা আমাকে কাছে ডেকে অনেক কিছু জানতে চাইলেন। প্রশ্ন করলেন। আমি সঠিক উত্তর দিয়েছিলাম। কবিতা শুনলেন। মনে পড়ে দাদা এতটাই আপ্লুত হয়েছিলেন যে, বিদায়বেলায় আমার বাবাকে অনুরোধ করে গেলেন, ‘মেম্বার সাহেব, আপনার এই মেয়েটাকে আপনি লেখাপড়া শিখান। অন্তত মেট্রিক পাশ সে জেন করে। এই মেয়ে বড় মেধাবী হবে”।

 

গুণদা সেই অনুরোধ বাবা রেখেছিলেন।

 

সেদিনের সেই কিশোরী বালিকা অনেক বড় হলো। কবিতা পড়তে শিখলো। বুঝতে শিখলো। কবিতার প্রেমে পড়লো। কবির প্রেমে পড়লো। লিখা-লিখির প্রেমে পড়লো।

 

 

ভাগ্য আমাকে দীর্ঘ বছর পরে আবার নির্মলেন্দু গুণদার সামনে হাজির হবার সুযোগ করে দিয়েছিল। কে, জানতে এতকাল পড়ে সেই মহা পুরুষের সঙ্গে আমার দেখা হবে। কথা হবে। আমার সহকর্মী হবেন। সেই সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আমি সবে সাংবাদিকতার নাম লিখিয়েছি।

 

আমার প্রথম সংবাদপত্র হাউজ বাংলাবাজার পত্রিকা। কবির সংগে সেখানেই দেখা। তখন আমাদের সম্পাদক জাকারিয়া খান গুণদাকে দিয়ে স্পেশাল কলাম লিখাতেন। গুণদা অফিসে আসতেন। সম্পাদক ছিলেন ক্রিকেট পাগল। ক্রিকেটটা অনেক বুঝতেন। খোজ-খবর রাখতেন। কোন ব্যাটসম্যানের স্টাইক রেট কত, বোলারের ইকোনমি কত গড়গড় করে বলে দিতেন মুখস্ত। আমি নবাগত। মুগ্ধ হয়ে জাকারিয়া ভাইয়ের সবকথা শ্রবণ করতাম। জাকারিয়া ভাই আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আমাকে ডাকতেন ‘লিচি’ বলে।

আরও পড়ুন  যাঁকে র‌্যাঙ্ক দিতে বাধ্য হন পাক জেনারেল

 

আমার ক্রিকেট নিয়ে লেখা নির্মলেন্দু গুণদা মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। তার প্রমাণ মিলেছে বেশ কয়েকবার। আমি আমার এক ক্রিকেট রিপোর্টে লিখেছিলাম- ‘বাংলাদেশ ব্যালেন্স দল’।

সম্পাদকের রুমে ক্রিকেট আলোচনায় গুন’দা আমাকে সুন্দর করে শুধরে দিলেন- লিসা, কথাটা ব্যালেন্স হবে না। হবে ‘ব্যালেন্সড’।

 

এরপর আর ভুল হয়নি। আমি যখনই ‘ব্যালেন্সড’ লিখতে যাই। প্রতিবার মনে পড়ে গুণদার শুদ্ধরে দেয়া।

 

মনে পড়ে সেই কিশোরী বয়সে এক গুনীজনের সান্নিধ্যের কথা।

 

আজ ২১ জুন দাদার জন্মদিন। পড়ের ক্যানভাসে সেই কিশোরি দিনের স্মৃতি ঘুরে -ফিরে সামনে।

যে কথা এখনও বলা হয়নি নির্মলেন্দু গুণ দাকে। স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়নি। আমিই সেই বালিকা।

“আবার যখনই দেখা হবে, আমি প্রথম সুযোগেই
বলে দেব স্ট্রেটকাটঃ

‘আমিই সেই বালিকা’।

যার কথায়, কবিতায় আপনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। অনুরোধ করেছিলেন আমার বাবাকে।
কবি’ কবির চোখে দেখেছিলেন আমাকে দূর দৃষ্টি। হয়তো কোন প্রভিতা দেখেছিলেন আমার মাঝে।
আমি প্রেমে পড়েছি। কবি’র কবিতা আমাকে প্রেম করা শিখিয়েছে। প্রেমে পড়তে শিখিয়েছে।

 

“আমায় তুমি যতোই ঠেলো দূরে
মহাকাশের নিয়ম কোথায় যাবে ?
আমি ফিরে আসবো ঘুরে ঘুরে
গ্রহ হলে উপগ্রহে পাবে !

মাটি হলে পাবে শস্য- বীজে
বাতাস হলে পাবে আমায় ঝড়ে !
মৃত্যু হলে বুঝবে আমি কি যে ,
ছিলেম তোমার সারাজীবন ধরে !

 

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।

সর্বশেষ সংবাদ