অমরত্বের প্রত্যাশা নেই

প্রকাশিত: ৩:০৩ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৭, ২০২০

অমরত্বের প্রত্যাশা নেই

ফারহানা ইসলাম লিনু: শৈত্য প্রবাহ কাটিয়ে পৌষের মিষ্টি রোদ উঠেছে। আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। যদিও শীতটা অসহনীয়। ঠান্ডা পানিতে হাত ডুবানো যায় না।

গৃহকর্মের প্রধান সহযোগী মহিলা কাজে আসেনি। কারণ অতি সাধারণ। জামাই মেরে হাত ভেঙে দিয়েছে। ছুটির দিনে গৃহকর্মীদের যে কোন একজন না আসলে আমি তেমন বিচলিত হইনা।
সংসারকর্মে আমার কোন বিরাগ নেই, একটু অনুরাগ আছে। কারণ ছুটির দিনের অবসরে মানেই বইপড়া ও দু’কলম লিখা।

বিভাগীয় প্রধান গৃহকর্মী বেচারির অনুপস্থিতিতে আমাকে খানিক বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে আজ। ঘরের কোথায় কি রাখা আছে সহকারী মেয়েটারও নখদর্পনে। আজকে এই মেয়েটাও আসেনি। আগের দিন সন্ধ্যায় ছেলে বন্ধুকে নিয়ে সাফরনে গিয়েছিলো চা খেতে। ডেটিং থেকে ফিরতে দেরি হয়েছে। যথারীতি বাপ শাসন করেছে, মা কড়া কথা শুনিয়েছে। বাপ মায়ের উপর অভিমান করে সে কর্মস্থলে আসেনি।

ডিপ ফ্রিজের ভেতর কল্লা ঢুকিয়ে আমি জিনিসপত্র হাতড়াচ্ছি। ঠান্ডায় বাহু পর্যন্ত হাত আমার অবশ।

হিম শীতের প্রভাতে লেপের ভেতর নাক ঢুকিয়ে পুরা সপ্তাহের জমিয়ে রাখা দাম্পত্য কাইজ্যা করবো, তা না করে মেরু অঞ্চলের বরফের ভেতর রান্নার মসল্লা খুঁজি।

ডিমের ঝোল দিয়ে দেড় প্লেট খিচুড়ি খেয়ে মনকে সান্ত্বনা দেই, “সাগরে পেতেছি শয্যা শিশিরে কি ভয়”। ময়লা কাপড়ের ঢেরি লেগে আছে লন্ড্রির ঝুড়িতে। পিড়ি পেতে কাপড়ে সাবান লাগাতে বসেছি। কাপড়গুলো মনের আনন্দে কেচে কুচে ধুয়ে দিবো। শরীরে জমে থাকা শর্করা ও স্নেহজাতীয় খাবারের বর্ধিত অংশ পুড়িয়ে আরেকবার লোড দিবো।

চিত্তসুখে গান ধরেছি, “নিথুয়া পাথারে নেমেছি বন্ধুরে, ধরো বন্ধু আমার কেহ নাই”। বেসুরো সঙ্গীতের প্রলয়ঙ্করী সুরের মূর্ছণায় পুত্রকন্যারা যে যার রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে নিঃশব্দে। কানে হাত দিয়ে গোপন ক্যামেরায় আমার কাপড় কাচার ছবি তুলছে একেকজন।

আরও পড়ুন  জল থইথই সিলেট

এইধরনের অপকর্মে আমার ভীষণ আপত্তি। রান্নাঘর থেকে তাড়ু, ঢেউয়া, হাতা নিয়ে তেড়ে যাই।

কলিংবেলের কর্কশ শব্দে সন্তানদের শাসনে ছন্দপতন হয়। দরজা খোলে দেখি আছিয়া ও সাফিয়ার জোড়া কন্যা হাজির।
কি ব্যাপার? তোমাদের মায়েরা যে আসবে না সে বিষয়ে আমি অবগত হয়েছি। তাহলে তোমারা এসেছো কেন?

নানি, আমরারে আম্মায় পাঠাইছে, আপনারে কামে সাদ দিতে কইছে, দুইজন সমস্বরে জানালো।

স্কুল পড়ুয়া, এই দুই বালিকা প্রায়শই তাদের মায়েদের কাজে সহায়তা করতে আসে। আমার ঘরের হালকা কাজের কলকব্জা তাদের জানা আছে। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ধুমধাম করে তারা ঘর ঝাড়ু দিতে লেগে যায়।

আমি আবার নিথুয়া পাথারের সুর তুলে বিমলানন্দে ভেজা কাপড়ে হাত লাগাই।

করিৎকর্মা ড্রাইভার এসে হাজির। তারতো মাথায় হাত। কাপড় ধোয়ার এই দৃশ্য সে সহ্য করতে পারে না।

বিদীর্ণ হৃদয় নিয়ে এগিয়ে আসে। মামানি হরইন চাইন, আপনে কেনে কাপড় ধুইতা? আমি ধুইয়া দিমু। কাপড়ের বালতি নিয়ে টানাটানিতে আমি পরাস্ত।

কাপড়ের বালতি ফেলে কোমরে কাপড় বেঁধে মাছ কুটতে লেগে যাই। সাপ্তাহিক বাজার এসেছে। গোছগাছ শেষ করে রান্না করতে হবে। মাছের বরফে হাত আবার নিহবদ।
সবকিছু রেডি করে হাতে হবদ আনতে পেপারটা নিয়ে একটু বসেছি। ডিপ ফ্রিজ থেকে বের করা মসল্লার বরফ গললে রান্না চড়াবো।

“অধিক সন্যাসীতে গাজন নষ্ট”। গৃহকর্মে অতি মনোযোগী ড্রাইভার কাপড় ধোয়া শেষ করে আমার অগোচরে রান্নাঘর গোছাতে ব্যস্ত। কুটে রাখা মাছ, মুরগী, চুলার পাশে রাখা মসল্লা, লবণ, তেল সবকিছু স্বস্থানে রেখে রান্নাঘর ধুয়েমুছে বেরিয়ে যায় বেচারা।
আধাঘন্টা পর রান্নাঘরে পা দিয়ে আমি তো হা। কোথায় সব জিনিসপত্র? বালিকাদের আমি আগেই রান্নাঘরে ঢুকতে নিষেধ করেছি। সুতরাং তারা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করবে না।
তাহলে কি “দ্যা ইলভস এন্ড দ্যা সুমেকারের” মতো অবস্থা হলো! অশরীরী কেউ এসে আমার কাজ এগিয়ে দিলো? সাত পাঁচে না গিয়ে আমি তিন চারে ভাবনা শেষ করি।

আরও পড়ুন  ৭ শর্তে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা

ড্রাইভারকে ফোন দিলাম, বাবাজি রান্নাঘরের জিনিসপত্র কে গুছিয়েছে?

মামী, আমি ঠিকঠাক কইরা থুইছি।

কেন করেছো, জিজ্ঞেস না করে আমি আবার মেরু অঞ্চলের বরফের ভেতর হাত কল্লা ঢুকিয়ে মাছ, মসল্লা বের করে আনি। বাইরের আবহাওয়া হিমাংকের নিচে না গেলেও ঠান্ডা নেহায়েত কম নয়। চল্লিশ/ পঁয়তাল্লিশ বছরের রেকর্ড নাকি ইতিমধ্যে ভেঙেছে। ফ্রিজের জিনিসপত্র বরফ হতে সময় লাগেনা।

বরফে পাথর জিনিসপত্র বের করে আমি পাথর চোখে তাকিয়ে আছি। কঠিন থেকে কোমল বানানো এখন সময়ের ব্যাপার।

একটা বিয়েতে যাওয়ার কথা ছিলো। সব কাজ শেষ করে যাওয়া সম্ভব হবে না।
তারপরও আমি ড্রাইভারের উপর রাগ করতে পারি না। আগলঠাইয়্যা এই ব্যক্তির আন্তরিক সুকর্ম এই প্রথম নয়। আগেও অনেকবার করেছে।

প্রতিবার বেচারা উপকার করতে গিয়ে নিজেও বিপদে পড়ে আবার আমাদের জন্যও দুর্ভোগ ডেকে আনে। সেই তুলনায় আজকের দুর্ভোগ নিতান্ত কম।

এইবার আমাদের সাথে তার দশম বছর হলো পূর্ণ হবে। দশ বছরের বিশেষ কিছু ঘটনা নিয়ে আমার এইবারের আয়োজন। চলবে ধারাবাহিক ভাবে।

ফারহানা ইসলাম লিনু পেশায় লেখক এবং সৌখিন লেখক

 

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।

সর্বশেষ সংবাদ