এই মুখরিত জীবনের চলার বাঁকে

প্রকাশিত: ১:৫৬ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২০

এই মুখরিত জীবনের চলার বাঁকে

ফারজানা ইসলাম লিনু : খেলাধুলার প্রতিযোগিতায় আমি বরাবরই রসগোল্লা। জীবনে কোনদিন খেলাধুলায় এক-দুইটা পুরষ্কারের পুটলা বা বাটি-ঘটি পথ ভুলেও আমার হস্তগত হয় নি।

প্রাইমারী স্কুলে থাকতে বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস বা আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করার কোন স্বচ্ছ স্মৃতি মনে পড়ে না। স্কুলের আঙ্গিনায় অংক দৌড়, স্মৃতি পরিক্ষা ও সুইয়ে সুতা পরিয়ে কতজন পুরস্কার নিয়ে প্রফুল্ল চিত্তে বাড়ি ফেরে আর আমি ঠেলা খেয়ে পেছনে পড়ে পরাজয়ের অশ্বডিম্ব নিয়ে মুখ কালো করে ঘরে আসি।
দূর, আর জীবনে খেলাধুলায় নামই দিবো না।

পুরস্কার গ্রহণের সুখস্মৃতি না থাকলে কি হবে? দাড়িয়াবান্ধা, কুত কুত, ছরি, বন্দি, ইচিং বিচিং বা ফুল গুটি খেলার কারণে চুলের ঝুটিতে টান ও তিরস্কার নিত্য জুটতো।

বড় পরিসরে খেলাধুলায় অংশগ্রহণের প্রচন্ড ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দুর্বল খেলোয়াড় হিসেবে কোন দলই নিতে চাইতো না। পছন্দের তালিকা থেকে বাদ পড়ে “খুলি হাল তুলি পাল” করে তরী ছেড়ে দেই না।
খুব মুলামুলি করে দলনেত্রীদের কাছ থেকে একটা সুযোগ নেই। কিন্তু ওপেনিংয়েই ধরা খেয়ে দলের বারোটা বাজিয়ে কাচুমাচু মুখে মাঠ থেকে বিতাড়িত হওয়া ছিলো নিত্য ঘটনা।

প্রাইমারি স্কুলের ডাকসাইটে দৌড়বিদরা সহপাঠি হলেও বয়স, সাইজ এবং ক্রীড়া দক্ষতার কারণে সমীহ করে চলতে হতো। দুই একদিন খেলতে গিয়ে তাদের উসাইন গতির কবলে পড়ে ছিটকে পড়েছি অনেক দূরে। টারশিয়ারি যুগের শক্ত টিলামাটিতে পড়ে হাঁটু ছিলে রক্তারক্তি। ‘উফ’ বলেছি নিরবে নিভৃতে। পাছে আবার “ছইতে মরা বলে”খেলায় নেয়া হবেনা।

এমনিতেই ফড়িংয়ের মতো শরীর ও দুর্বল পায়ে দৌড়ানোর কারণে খুব ঠেকায় না পড়লে দলে স্থান মিলতো না। দর্শক সারিতে পানসে মুখে বসে থাকা ছাড়া কোন উপায় ছিল না।

প্রাইমারী স্কুল পাশের পর সেইসব ডাকসাইটে খেলোয়াড়দের বেশিরভাগের পড়াশোনায় ইতি ঘটে বাল্যবিবাহ বা পারিবারিক প্রতিবন্ধকতার কারণে।

অঁজো পাড়া গাঁ থেকে তুলনামূলক মফস্বলের হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে অনেক উচ্ছ্বসিত আমরা দুই সহপাঠী চাচাতো বোন, আমি ও জোছনা।

এখনকার মত এত হাইস্কুল ছিল না। একটা মাত্র ছেলেদের স্কুল আর একটা মেয়েদের স্কুল। মেয়েদের স্কুলটার নাম বড়লেখা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। অনেক ছাত্রী এই স্কুলে। পরিবেশও অনেক আধুনিক। তুলনামূলক ভালো পড়াশোনার উদ্দেশ্যে মুড়াউল, কাঁঠালতলি থেকে অনেকে ট্রেনে বা বাসে চড়ে আসতো এই স্কুলে।

স্কুলে ভর্তি হয়েই দেখি বিশাল আয়োজনে চলছে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। খালি মেয়েদের স্কুল হওয়াতে স্কুলের ভেতরে ঘুরাঘুরির আনলিমিটেড স্বাধীনতা। ইচ্ছামত স্কুলের পুকুর পার ওপাশের বড় মাঠ সব জায়গায় যাওয়ার সুযোগ ছিল।

সমবয়সী মামাতো বোন বর্নাদের স্কুলে ছেলেমেয়েরা একসাথে পড়ে। তাই মেয়েদের অবাধে স্কুলের মাঠে চষে বেড়ানোর সুযোগ ছিল না। ক্লাস শেষে মেয়েরা স্যারের পিছু পিছু বেরিয়ে এসে কমনরুমের খাঁচায় বসতো। কমন রুম টু ক্লাসরুম এই পর্যন্ত ছিল তাদের দৌড়। আমাদের সে রকম বাধ্যবাধকতা না থাকায় স্বভাবতই কি আনন্দ আকাশে বাতাসে।

কি আনন্দের মেলায় স্কুলের বড় আপাকে কিন্তু প্রথম দিন থেকেই যমের ভয় পেতাম। কেন ভয় পেতাম তা আজও জানিনা। যদিও বড় আপার মতো স্নেহপ্রবন ও পরিপাটি মহিলা এই জীবনে খুব কমই দেখেছি।

একজন চারটা করে খেলায় নাম দিতে পারবে। আমিও সাহস করে চারটা খেলায় নাম দিয়ে দিলাম। প্রতি খেলায় সিলেকশন রাউন্ডেই আউট। বিশেষ করে বস্তা দৌড়ে নাম দিয়ে তো লেজে গোবরে অবস্থা। দুটো লাফ দিতে না দিতেই মাঝ মাঠে পড়ে ডলফিনের মতো গড়াগড়ি। বস্তার ভেতর শরীরের অর্ধ্বাংশ, হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। না পারি উঠতে, না পারি দৌড়াতে।

আরও পড়ুন  ষড়যন্ত্র করে নির্বাচন বানচাল করা যাবে না : পরিবেশমন্ত্রী

বিতিকিচ্ছিরি এক অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেয়ে আবার লাঠি হাতে হাঁড়ি ভাঙতে লাইনে দাঁড়াই। বিস্তারিত আর নাই বা বললাম। চোখ বেঁধে লাঠি হাতে পথ হারিয়ে এদিক সেদিক দৌড়াতে গিয়ে কোন কূল কিনারা পাইনা। কার না কার মাথায় বাড়ি দিয়ে দেই সেই ভয়ে চোখের বাঁধন খুলে দেখি হাঁড়ি উত্তর মেরুতে আর আমি দক্ষিণ মেরুতে। যথারীতি চোখের অন্ধকার ভাব কাটিয়ে মাঠ থেকে বেরিয়ে আসি।

মাথায় কলসি নিয়ে দৌড়াতে গিয়েও একই অবস্থা। দুই কদম যেতে না যেতেই কলসি পড়ে ঠাস। বারবার পরাজয়ের গ্লানি মাথায় নিয়ে কত আর মাঠে থাকা যায়? অনিচ্ছায় মাঠ থেকে বিতাড়িত হলেও শখ ভোতা হয় না।

“জয় পরাজয় বড় কথা নয়, অংশগ্রহণই বড় কথা ” এই অপ্তবাক্যের কথা স্মরণ করে আবার নিজেকে তৈরি করি।
একবার না পারিলে দেখো শত বার। শতবার কি? দ্বিতীয়বারও বাছাইপর্বে কলসি ভাঙার সুযোগ নেই।বেখামা ও বাদাইম্যাদের জন্য দর্শক গ্যালারি উপযুক্ত স্থান।
কিন্তু সহপাঠীদের দুর্দান্ত সব অর্জন দেখে নিজেকে আবার ধরে রাখা দায়। লং জাম্প, হাইজাম্প, গোলক নিক্ষেপ ও বর্শা নিক্ষেপে দুধর্ষ জয় ছিনিয়ে এনে গা জ্বলা হাসি দিচ্ছে।

যদিও এইসব নিক্ষেপের খেলায় অংশগ্রহণের ন্যুনতম যোগ্যতা আমার নেই। কুঁজোর ইচ্ছে হয় সোজা হয়ে শোওয়ার। এই মর্মে মাঠের এক কোনায় রাখা ভারী গোলক হাতে নিয়ে পরিক্ষা মূলক একটু তোলা দিলাম। বুঝতে বাকি থাকলো না কুজোদের শখ কেন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়।

পরম নিষ্ঠা ও কঠিন অনুশীলন শেষে নিজের চেয়ে অধিক ওজনের গোলক নিক্ষেপ করতে গেলে গোলক বা চাকতির আগে আমিই নিক্ষেপিত হবো নির্ঘাত।

অভাগা যে দিকে চায় সাগর শুকায়। আমি অভাগার খেলাধুলায় অংশ গ্রহণ যখন চরম হতাশার পর্যায়ে তখন সাগরে কিঞ্চিৎ পানির উদয় হলো। নিজেকে অবাক করে
কি করে যেন দড়ি লাফের বাছাইপর্বে টিকে গেলাম।

এখন বিভিন্নগ্রুপের বাছাইপর্বের খেলোয়াড়দের নিয়ে ফাইনাল হবে। অবশেষে একটা খেলার ফাইনালে খেলবো এই উত্তেজনায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। মনে মনে প্রাইমারী থেকে ঝরে যাওয়া সুদক্ষ খেলোয়াড়দের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

ঘরে দড়ি লাফের দড়ি নেই। মোকামের জঙ্গল থেকে শতবর্ষি বট গাছের ডাল বেয়ে নেমে আসা শক্ত বুনো লতা একটা কোনমতে জোগাড় হল। বাড়ির উঠানে চলছে বিরামহীন ঘাম ঝরানো প্রশিক্ষণ। দিন নাই রাত নাই খালি দড়ি লাফ আর দড়ি লাফ।

ঘনিয়ে আসছে বহু প্রতীক্ষিত ফাইনালের দিন।

বেশ বড়সড় আয়োজনে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান নির্ধারনী চুড়ান্ত হবে। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। স্কুল ড্রেস পরে সাদা ফিতা দিয়ে চুলে ঝুটি বেঁধে বেশ ভালো ভাবে তৈরী হয়ে যেতে হবে স্কুলে।

আব্বা ঢাকা থেকে স্কুল ড্রেসের সাথে সাদা স্কুল সু, চুলের ফিতা সব পাঠিয়েছেন। প্যাকেট খুলে আবারও অনাকাঙ্ক্ষিত বিপর্যয়ের মুখোমুখি হলাম। দুর্ভাগ্যক্রমে জামাটার কালার কচুয়া সবুজের জায়গায় পীত সবুজ হয়ে গিয়েছে। এই কালার দিয়ে আমি ক্লাসে উপস্থিত হতে পারলেও কোন অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করতে পারবো না।

আরও পড়ুন  বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা স্থগিত করল ওমান

একদিনের ভেতর আরেকটা ড্রেস বানানোর সূদুর পরাহত দাবি মামা বাড়ির আবদার ছাড়া কিছু নয়। আমার দড়ি লাফের কঠোর অধ্যাবসায় এইবার মুখ থুবড়ে পড়ে।

খুব বড় সড় পুরষ্কার বিতরনী অনুষ্ঠান। দড়ি লাফে অংশগ্রহণের সমূহ অনিশ্চয়তা নিয়ে আমি স্কুলে যাই। লাল নীল কাগজ কেটে লম্বা সুতলিতে গমের আঠা দিয়ে লাগিয়ে স্কুল প্রাঙ্গণ সুসজ্জিত করা হয়েছে। মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে কখন, কিভাবে ফুলের তোড়া ও মালা দিয়ে মহান অতিথিকে বরণ করে নিতে হবে। সেই সাথে উচ্চস্বরে বলতে হবে, মহান অতিথির আগমন শুভেচ্ছা স্বাগতম।

ড্রেসের বিড়ম্বনায় আমি কেবল মাঠের ফাইনালে না মার্চ পাস্ট, পিটি ও অতিথিদেরকে স্বাগত জানানো থেকে ছিটকে পড়ি। এই নিয়ে আমার মন যারপরনাই খারাপ। তার উপর ভয়ে আছি ড্রেসের ভয়ংকর কালারের কারণে যদি স্কুলের বড় আপার কাছে বকা খেতে হয়।

যদিও ভীড়ের ভেতর বিড়ম্বিত কালারের স্কুল ড্রেস পরিহিত স্বজাতির কয়েকজনকে দেখে কিঞ্চিৎ সান্ত্বনা পাই। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ না করায় তাদের বিপদের সম্ভাবনা কম।

অনুষ্ঠানের দিন নিজেকে যতটুকু পারা যায় আড়ালে আবডালে লুকিয়ে রাখি। খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে বেশ সক্রিয় অগ্রজ চাচাতো বোন আসমানী আপা, আমাকে ও জোছনাকে একটা বেঞ্চ টেনে মাঠের একপাশে বসিয়ে দিলেন। যেখান থেকে সব গুলো খেলা ভালো করে দেখা যায়।

স্কুলের নতুন পরিবেশে এখনো ভাল করে মানিয়ে নিতে পারিনি। অনেকটা জড়সড় হয়ে বসেছি। অমনি একটা মেয়ে আমাদের সাথেই নতুন ক্লাসে ভর্তি হয়েছে, এসে দাঁড়ায় আমাদের সামনে। সাথে তার অনেকগুলো ছোট ভাইবোন। খুব কড়া গলায় বলে, এই তোমরা ওঠ, পুরো বেঞ্চিটাই আমাদের লাগবে।

আমরা উঠতে কিছুটা অস্বীকৃতি জানালে মেয়েটা ক্ষেপে যায়। ভাইবোনদের সবাইকে আমাদের পাশে একপ্রকার জোর করে চিপাচিপি করে বসিয়ে দেয়। সবার শেষে সে নিজে বসে জোরছে এক ঠেলা মারে। পাখির মত হালকা পাতলা শরীর নিয়ে দুই বোন ছিটকে পড়ি বেশ দূরে। মুখ কালো করে হাত পায়ের বালু ঝেড়ে উঠতে গিয়ে

এই করুণ পরিণতি দেখে অগ্রজের মেজাজ গেলো বিগড়ে। আচ্ছামত দুটো ধমক লাগাতে না লাগাতেই মেয়েটার বড় বোন এসে হাজির। এইবার আসমানী আপা ও সেই বড় বোনের মধ্যে ছোট খাটো একটা বচসাও হয়ে গেল।

স্কুলে ক্লাস শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া সেই মেয়েটির সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়। পরবর্তীতে এক রুমের বাসিন্দা হওয়ার সুবাদে সেই বন্ধুত্বের বন্ধন আরো দৃঢ় হয়।
চমৎকার হাতের রান্না ও আন্তরিকতায় গুন্ডি সহপাঠীর সেদিনের কৃতকর্ম ম্লান হলেও পীত সবুজ জামার দুঃখ আজও ম্লান হয়নি। এই উদ্ভট পীত সবুজ জামার কারণে পরবর্তী এক বছর আমি স্কুলের কোন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারিনি।

সেই অম্ল স্মৃতির পীত সবুজ রঙটা দেখলে আজও সেই দুঃখ উথলে উঠে।

ফারজানা ইসলাম লিনু, শিক্ষক ও গল্পকার, সিলেট।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।

সর্বশেষ সংবাদ