মূলধারার গণমাধ্যমে আস্থায় অবিচল থাকুন

প্রকাশিত: ১০:৩৮ অপরাহ্ণ, জুন ৯, ২০২০

মূলধারার গণমাধ্যমে আস্থায় অবিচল থাকুন

সোমবার (৮ জুন) অপরাহ্নে গুজবে সয়লাব বাংলাদেশ। সোশ্যাল মিডিয়ায় একের পর এক আজগুবি খবর। বিভিন্ন ব্যক্তিগত আইডি এবং নাম সর্বস্ব অনলাইন পোর্টাল এসব ডাহা মিথ্যা, আমনবিক, মনুষ্যচরিত্র বিবর্জিত খবর প্রকাশ করে। সোশ্যাল মিডিয়ার এসব খবর দেখে অনেক সচেতন মানুষ উদ্বেগ উৎকন্ঠিত হয়ে কল করতে থাকেন দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে। আমরা যারা গণমাধ্যমে কাজ করি, আমাদেরকেই সমাজের বিরাট সংখ্যক মানুষ আস্থা ও বিশ্বাসের ভরসাস্থল মনে করে। প্রযুক্তির অবাধ অবৈধ ও অনৈতিক ব্যবহার আমাদের এ অবস্থানে বারবার ধাক্কা দিচ্ছে। অনেকটা ভূমিকম্পের মত এসব ঝাঁকুনি। কখনো পেঁয়াজের, কখনো লবনের দাম বৃদ্ধির ‘খবর’ রটিয়ে, কখনো জনপ্রিয় রজিনীতিকের ‘মৃত্যু’ তারও আগে ‘চাঁদে দেখা’ গেছে অমুককে এরকম মিথ্যাচার করে।  কিছুসময় পরে এসব ‘গুজব’ হিসেবে প্রমাণিত হয়। তার আগে অসাধুচক্র বা ‘তথ্যসন্ত্রাসী’ বা রটনাকারীরা তাদের ফায়দা হাসিল করে নেয়।

সোমবার (৮ জুন) অপরাহ্নে ফেসবুকে প্রচার হলো এমনি নির্লজ্জ মিথ্যা খবর। সিলেটের সাবেক মেয়র জনপ্রিয় রাজনীতিবীদ বদর উদ্দিন আহমদ কামরান মারা গেছেন। মুহুর্তেই এ খবর ভাইরাল হয়ে উঠে। উৎকন্ঠিত সিলেটবাসী যে যেখান থেকে পারেন খবরের সত্যতা যাচাই করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আমাদের কাছে কলের পর কল আসতে থাকে। আমরা খোঁজ নিলাম। চিকিৎসাধীন কামরানের পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বল্লাম। জানলাম তিনি সুস্থ আছেন, প্লাজমা থেরাপী দেয়া হচ্ছে। মূলধারার গণমাধ্যম মানে দৈনিক পত্রিকা ও টেলিভিশন কামরানের বাস্তব অবস্থার খবর প্রচার ও প্রকাশ করলো। মানুষ বুঝে উঠলো ‘মৃত্যুসংবাদ’ গুজব। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলো।

ঘন্টা দু’য়েক যেতে না যেতেই আবার অস্থির খবর। কী? সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম মারা গেছেন। আবার ফোন , আবা উদ্বেগ। আবারো মূলধারার গণমাধ্যমগুলো জানান দিল নাসিম জীবিত আছেন, সংকটময় সময় পার করছেন। এ সংবাদটাও গুজব তা বুঝে উঠার আগেই খবর প্রচার হলো আল্লামা শফি ইন্তেকাল করেছেন। মূলধারার পত্রিকা টেলিভিশন জানালো এটাও গুজব। আল্লামা শফি’র চিকিৎসা চলছে। তিনি ইন্তেকাল করেননি। ২০১৪ সালে ‘সাঈদী চাঁদে দেখা গেছে” এমন একটা খবরে উত্তরবঙ্গে তুলকালাম কান্ড ঘটে গেল। মানুষ বেরিয়ে পড়লো। পুলিশ- জনতা সংঘর্ষে প্রাণহানি ঘটলো।

আরও পড়ুন  ‘নৌকা তো ডুবুডুবু, সাগর পাড়ি দেবেন কীভাবে?’

প্রশ্ন হলো এসব মিথ্যাচার, অসত্য সংবাদ বা গুজব কারা ছড়ায়?  কেন ছড়ায়?

গত ৫/৬ বছরে প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারের ফলে বহু অনলাইন পোর্টাল গড়ে উঠেছে। কোন ধরনের নিয়ম-নীতি ছাড়াই তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে এসব পোর্টাল তথ্য সংবাদ প্রকাশ করে। এমনকি লাইভ সম্প্রচারও এদের অনেকে করে । জনগণের একটা অংশ এসব পোর্টালকে সংবাদ মাধ্যম মনে করে থাকেন। প্রকৃত অর্থে এগুলো সংবাদ মাধ্যম বা গণমাধ্যম না। সংবাদ বা তথ্য প্রচার সম্প্রচার এদের অনৈতিক চর্চা। সহজ কথায় ফেসবুকে একটা পেজ খুলে অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তি পোর্টাল খুলে নেন। নিজেই দাবী করেন –ডটকম সম্পাদক বা সাংবাদিক।

প্রকৃতপক্ষে একটা টেলিভিশন কিংবা পত্রিকা প্রকাশ করতে সরকারের বিধি মোতাবেক ডিক্লারেশন নিতে হয়। এই ডিক্লারেশন নিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক পরিচয়, অর্থনৈতিক সক্ষমতা, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত করে দেখেন। তারপর সব সঠিক পাওয়া গেলে পরে একটা অংগীকারনামার মাধ্যমেই তিনি পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক, প্রকাশক, সম্পাদক হন। এক্ষেত্রে সংবাদ প্রচার ও প্রকাশে একটা জবাবদিহিতা থাকে। থাকে নির্দ্ধিষ্ট সিস্টেম। সংবাদের সত্যতা, গ্রহণযোগ্যতা যাচাই বাছাই করে যথাযথ সম্পাদনা করে তবেই প্রকাশ করা হয়। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া পোর্টাল বা ডটকম নামধারী সাংবাদিকরা এসবের ধার ধারেন না। তারা যখন যেখানে যেটা পান সেটাই প্রচার করেন।

সস্তা জনপ্রিয়তা লাভে এরাই গুজব ছড়ায়।

দ্বিতীয়ত :আরেক শ্রেণী, সোশ্যাল মিডিয়া যেমন ফেসবুক টুইটার ইন্সট্রাগ্রাম এগুলোকে সাংবাদিকতার মাধ্যম মনে করেন। এরা মনে করেন এটা সামাজিক সাংবাদিকতা। তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ঘটনা, দূর্ঘটনা ,অপরাধ, খুন -হত্যার খবর তাদের আইডি থেকে প্রচার করে থাকেন। এটা যে সবক্ষেত্রে নেতিবাচক তা বলা যাবে না। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির চিন্তা, চেতনা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে তার এই সামাজিক সাংবাদিকতা সমাজের জন্য কতটুকু ইতিবাচক না নেতিবাচক। কারণ এক্ষেত্রে প্রচারকারীর কোন জবাবদিহিতা নেই। তিনি যা মনে করেন, তাই প্রচার করতে পারেন। তা ভুল হোক, শুদ্ধ হোক আর গুজব হোক।

আরও পড়ুন  স্বর্ণজয়ী সুপি’র এগিয়ে যাবার গল্প

স্বার্থান্বেষী একটি মহল আছে। তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলে তৃতীয় পক্ষকে ব্যবহার করে অনেক সময় খবর ছড়ায়। যা পরবর্তীতে গুজব বলা হয়। তার আগেই এরা ফায়দা লুটে নেয়।

পরিত্রাণের উপায় কি? প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান বিকাশে এর ব্যবহার রোধ করা যাবেনা। ব্যবহারকে আনতে হবে নিয়মের আওতায়। আইনের অধীনে। প্রচার প্রকাশের ক্ষেত্রে আইনের বিধি-বিধান কঠোরভাবে কার্যকর করতে হবে। তথ্য সংবাদ প্রচার আর সামাজিক যোগাযোগকে আলাদা করতে হবে। তথ্য সংবাদ প্রচারে আগ্রহীদের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা যাচাই বাছাই করে তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। এসব করতে হবে সরকারকে।

সোমবারের এইসব গুজব রটনাকারী কাউকে এখনো আইনের আওতায় আনার খবর আমরা পাইনি। এতে আমাদের উদ্বেগ উৎকন্ঠার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আমরা মনে করি, সরকার বা প্রশাসন এর সব দায়িত্ব পালন করতে চাইবেনা। বা করবেনা। অথবা অনেক ক্ষেত্রে করতে পারবেনা।

কাজেই জনগণকে সচেতন হতে হবে। মূলধারার পত্রিকা, টেলিভিশনের খবরে আস্থাশীল থাকতে হবে। মনে রাখবেন কামরান, নাসিম ,আল্লামা শফি এরা জাতীয় ব্যক্তিত্ব। এদের সংবাদ মূল গণমাধ্যম অবশ্যই প্রকাশ করবে। যে কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংবাদ জাতীয় এবং স্থানীয় গণমাধ্যম প্রচারে দায়বদ্ধতা আছে। কোথাকার কোন্ ডটকম সংবাদ প্রচার করলো আপনি শেয়ার দিয়ে দিলেন। লাইকও দিলেন। একটু বুঝে শোনে দেন। তাড়াহুড়ার কি? সব খবর, সবার আগে আপনি জানানোর দায়িত্বটা নেবেন না। ফেসবুক ব্যবহার করেন। ভাল কথা। অন্যের প্রচারিত খবর তথ্য সংবাদ কপি করে পোস্ট করতে যাবেন না। এটা অসত্যও হতে পারে। হতে পারে মিথ্যা, গুজব। আপনার দায়িত্বশীলতা, নৈতিকতাই পারে গুজবের হাত থেকে বাঁচাতে।

আমরা উদাত্ত আহবান জানাই, মূল ধারার কাগজের প্রতি, পত্রিকার প্রতি, টেলিভিশনের প্রতি বা তাদের অনলাইন ভার্সনের প্রতিই বিশ্বাস রাখুন। দেখুন, পড়ুন প্রচার করুন। আপনার জানবার, জবাবদিহিতা সুযোগ আছে।

কবীর সোহেল   

৯ জুন,২০২০।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।

সর্বশেষ সংবাদ