ইসমত আরার ‘বৃদ্ধাশ্রম’

প্রকাশিত: ৬:৫৬ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ৪, ২০২৩

ইসমত আরার ‘বৃদ্ধাশ্রম’

প্রভাতবেলা ডেস্ক:

বৃদ্ধা রোকেয়া বেগমের স্বামীর মৃত্যুর পর খোঁজখবর নেয়া বন্ধ করে দেন দুই ছেলে। তার দিন কাটছিল কখনো আধপেটা, কখনো না খেয়ে। রোকেয়ার যাওয়ার জায়গা ছিল না কোথাও। তার দিন কাটছিল অর্ধাহারে-অনাহারে অনেক কষ্টে। এমন সময় একটি বৃদ্ধাশ্রমের খোঁজ পান তিনি। সেটা ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডুর ইসমত আরার। সুদূর কুষ্টিয়া শহর ছেড়ে থাকা-খাওয়ার সুযোগ থাকায় আশ্রয় নেন ইসমত আরার সেই বৃদ্ধাশ্রমে।

 

বিয়ের পর দু’বছর সংসার করেছেন ফরিদপুরের রাশিদা বেগম। স্বামী তাড়িয়ে দেওয়ার পর বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তার বাবার মৃত্যুর পর ভাইয়েরা তার ভরণ-পোষণ করতে চাননি। কষ্ট করে নিজেই উপার্জন করতেন। এখন উপার্জন বন্ধ, যাওয়ার জায়গাও নেই। এমতাবস্থায় তিনিও আশ্রয় নিয়েছেন ঐ বৃদ্ধাশ্রমে।

 

রোকেয়া-রাশিদার মতো ২২ জন বৃদ্ধার ইসমত আরার বৃদ্ধাশ্রমে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে। যারা তিন বেলা খাবারের পাশাপাশি পরনের কাপড় পাচ্ছেন। তেল-সাবান সবই দিচ্ছেন ইসমত আরা। সবাই মিলে প্রতিদিন নিয়ম করে গল্প বলার আসর বসানো হয় বৃদ্ধাশ্রমে। ইসমত আরা (৫৫) ঝিনাইদহ হরিণাকুণ্ডু উপজেলার জোড়াপুকুরিয়া গ্রামের মৃত শফি উদ্দিন বিশ্বাসের স্ত্রী।

 

হঠাৎ বৃদ্ধাশ্রম চালু করার মতো জনসেবামূলক কাজ করার চিন্তা মাথায় এলো কীভাবে, জানতে চাইলে ইসমত আরা বলেন, বেশকিছু বছর আগে পুত্রবধূদের লাঞ্ছনা-বঞ্চনা সহ্য না করতে পেরে প্রতিবেশী এক বৃদ্ধা কীটনাশক পান করেছিলেন। চিকিৎসায় ঐ নারী বেঁচে ফিরলেও তাকে বাড়িতে আশ্রয় দেননি সন্তানেরা। অসহায় অবস্থা দেখে ঐ নারীকে আমার বাড়িতে আশ্রয় দেই। এরপর পাড়ার আরো দুই-তিনজন বৃদ্ধাকে আশ্রয় দেই। এ ঘটনার পর আমার মাথায় বৃদ্ধাশ্রম তৈরির ভাবনা আসে।

আরও পড়ুন  অগ্রিম টিকিট মিলবে ১ সপ্তাহ আগে

 

ইসমত জানান, ২০০৯ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বৃদ্ধাশ্রমের কাজ শুরু করেন। স্বামীর দেওয়া তিন শতক জমিতে নিজ খরচে একটি টিনের ঘর বানান। থাকার ব্যবস্থা করার পর একে একে ১৩ জন বৃদ্ধা চলে আসেন। তিনি নিজে হাতের কাজ করতেন। পাশাপাশি বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ করে যে আয় হতো, তা দিয়ে বৃদ্ধাদের খাবারসহ অন্যান্য খরচ মেটানো হতো। তার স্বামীও প্রতিমাসে কিছু টাকা দিতেন। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমে তিনি কাজটি করে যাচ্ছেন।

ইসমত আরা জানান, বৃদ্ধাশ্রম শুরুর প্রথমদিকে মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হতো। পল্লীনকশা নামে নিজের হস্তশিল্প কারখানার বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে যে টাকা আয় করতেন, তা দিয়ে ঐ খরচ মেটাতেন। স্বামীর আয়ে চলছে সংসার, আর তার আয়ে চলছে বৃদ্ধাশ্রম।

তিনি জানান, এখন বৃদ্ধাশ্রমের পরিধি বেড়েছে। জেলা পরিষদ ২২ লাখ টাকা ব্যয় করে ২০১৯ সালে তিন কক্ষের একটি পাকা ঘর বানিয়ে দিয়েছে। সেখানে বৃদ্ধারা আরামে থাকতে পারছেন। বর্তমানে বৃদ্ধাশ্রমে ব্যয়ও বেড়েছে। এখন মাসে ৩০০ কেজি চাল লাগে। সাপ্তাহিক বাজার লাগে সাড়ে ৪ হাজার টাকার। তেল, সাবানসহ প্রসাধনসামগ্রীতে মাসে খরচ হয় আড়াই হাজার টাকা। এ ছাড়া বৃদ্ধা নারীদের ওষুধ, কাপড়, বিদ্যুৎ বিলসহ বিভিন্ন খরচ রয়েছে। সব মিলিয়ে মাসে প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। বৃদ্ধাদের পরনের কাপড় জাকাতের কাপড় থেকে হয়ে যায় বলে তিনি জানান।

আরও পড়ুন  গাইবান্ধা সাদুল্যাপুরে বজ্রপাতে একই পরিবারের ৩ জনের মৃত্যু

শুরু থেকেই বৃদ্ধাশ্রমে আছেন নিমরী খাতুন। তিনি বলেন, বৃদ্ধাশ্রমটি প্রতিষ্ঠা করতে অনেক কষ্ট করেছেন ইসমত আরা। এখনো করে যাচ্ছেন। নিজের ব্যবসার সব আয় বৃদ্ধাশ্রমে ব্যয় করছেন। হাতের কাজের কারখানার আয়ও বৃদ্ধাশ্রমে খরচ হচ্ছে। এ ছাড়া এলাকার কিছু মানুষ সহযোগিতা করেন।

হরিণাকুণ্ডু পৌরসভার মেয়র ফারুক হোসেন জানান, সময় পেলেই মাঝেমধ্যে তিনি বৃদ্ধাশ্রমে যান। ইসমত আরার বৃদ্ধাশ্রমটি অজপাড়াগাঁয়ের একটি মডেল হয়ে গেছে। এলাকার বৃদ্ধারা এখন আর নিজেদের অসহায় মনে করেন না। পরিবারে সমস্যা হলে আশ্রয় নেন বৃদ্ধাশ্রমে।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।

সর্বশেষ সংবাদ