ঘূর্ণিঝড় রেমাল : বিধ্বস্ত উপকূলে মানুষের হাহাকার

প্রকাশিত: ২:০৬ অপরাহ্ণ, মে ২৮, ২০২৪

ঘূর্ণিঝড় রেমাল : বিধ্বস্ত উপকূলে মানুষের হাহাকার
প্রভাতবেলা ডেস্ক: দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ১৯ জেলায় ভয়ংকর তাণ্ডব চালিয়ে প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমাল অবশেষে দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু রেমালের কয়েক ঘণ্টাব্যাপী তাণ্ডবে স্বজন হারানোর পাশাপাশি ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির শিকার উপকূলের মানুষের হাহাকার করারও উপায় নেই। খাদ্য ও পানির সংকট তাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। সরকারিভাবে এ দুর্যোগে এ পর্যন্ত ১০ জনের মৃত্যুর কথা স্বীকার করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে পৌনে তিন কোটি গ্রাহক বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেট নেটওয়ার্কেও বিঘ্ন ঘটেছে। ফলে কোনো কোনো এলাকায় বিভীষিকাময় পরিবেশ বিরাজ করছে। উপকূল এলাকার গাছপালার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গাছ উপড়ে পড়ে বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

রেমালের ভয়ংকর তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাগেরহাটের মোংলা, পটুয়াখালীর খেপুপাড়াসহ উপকূল ও তার আশপাশের ১৯টি জেলা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে খেপুপাড়া, সুন্দরবন ও সাতক্ষীরার শ্যামনগরে। বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে বিস্তীর্ণ অঞ্চল। এখনও জলবন্দি রয়েছে লক্ষাধিক মানুষ।

রেমালে ক্ষতি হয়েছে দেড় লাখ ঘরবাড়ির। জোয়ারে ভেসে গেছে উপকূলীয় অঞ্চলের মৎস্যঘেরের কয়েকশ কোটি টাকার মাছ। কেবল বাগেরহাট জেলায়ই প্রায় ২২ হাজার মৎস্যঘের তলিয়ে যাওয়ার তথ্য জানিয়েছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা। তবে কৃষি খাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনও জানা যায়নি। দেশের পৌনে তিন কোটি মানুষ বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় বিদ্যুৎ বিভাগের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০০ কোটি টাকা।

ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির কারণে দেশের ১৯ উপজেলা পরিষদের নির্বাচন স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বিমান পরিষেবা। সোমবার (২৭ মে) হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে আন্তর্জাতিক রুটের ১১টি ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে।

এদিকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে রাজধানী ঢাকায় ১৫১ এবং চট্টগ্রাম নগরীতে ২৩৫ মিলিমিটারের ভারীবর্ষণে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। তা ছাড়া সারা দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩ হাজার ৩৩৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আজ মঙ্গলবারও বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

গত রবিবার সন্ধ্যা ৬টায় প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমালের কেন্দ্র বাংলাদেশের বাগেরহাটের মোংলার দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ (সাগর আইল্যান্ড) ও পটুয়াখালীর খেপুপাড়া হয়ে উপকূলে আঘাত হানে। এ সময় ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রের ৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৯০ কিমি, যা দমকা হাওয়া আকারে ১২০ কিমি পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। রেমালের মূল কেন্দ্র রাত ৮টা থেকে উপকূল অতিক্রম শুরু করে শেষ হয় সোমবার ভোর ৬টায়। তবে পুরো কাঠামো উপকূল অতিক্রম করে সকাল ১০টার মধ্যে। ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগ বাংলাদেশে আঘাত হানে গত রবিবার দুপুর ২টায়। জোয়ারের পানিতে ভেসে যায় সুন্দরবনের বিস্তৃত অঞ্চল।

৬ জেলায় ১০ জনের মৃত্যু

ঘূর্ণিঝড় রেমালে এক শিশু ও এক নারীসহ ১০ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান। সোমবার বিকালে সচিবালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, সোমবার দুপুর ১টা পর্যন্ত দেশের ছয় জেলায় এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। মৃতদের মধ্যে রয়েছেনÑ খুলনার লাল চাদ মোড়ল (৩৬); সাতক্ষীরার শওকত মোড়ল (৬৫), বরিশালের জালাল সিকদার (৫৫), মোকলেছ (২৮) ও লোকমান হোসেন (৫৮); পটুয়াখালীর শহীদ (২৭); ভোলার জাহাংগীর (৫০), মাইশা (৪) ও মনেজা খাতুন (৫৪) এবং চট্টগ্রামের ছাইফুল ইসলাম হৃদয় (২৬)। প্রতিমন্ত্রী জানান, গাছ উপড়ে পড়ে, জলোচ্ছ্বাসের পানিতে ডুবে, দেয়াল ধসে এবং আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পথে এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

প্রতিমন্ত্রী জানান, রেমালের কারণে দেশের বিভিন্ন জেলায় দেড় লাখ বাড়িঘরের ক্ষতি হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে ৩৫ হাজার ৪৮৩টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। আর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৯৯২টি ঘরবাড়ি।

আরও পড়ুন  ‘লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার ২০১৮’ নির্বাচিত মিম মানতাশা

তিনি জানান, ঘূর্ণিঝড়ে ১৯টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; যার মধ্যে আছেÑ খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা, ফেনী, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর ও যশোর। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলার সংখ্যা ১০৭ এবং ইউনিয়ন ও পৌরসভার সংখ্যা ৯১৪। রেমালে মোট ৩৭ লাখ ৫৮ হাজার ৯৬ জনের ক্ষতি হওয়ার তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা আগের তুলনায় অনেক বেশি। অনেক এলাকায় এখনও জলাবদ্ধতা আছে। মাছের ঘের, গাছপালা নষ্ট হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বিস্তারিত জানানো হবে।’

প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান জানান, উপকূলে মোট ৯ হাজার ৪২৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছে আট লাখেরও বেশি মানুষ। গরু-মহিষ, ছাগল-ভেড়াসহ আশ্রিত পশুর সংখ্যা ৫২ হাজার ১৪৬টি। দুর্গত লোকজনকে চিকিৎসাসেবা দিতে ১৪০০ মেডিকেল টিম কাজ করছে বলে জানান তিনি। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ৩ কোটি ৮৫ লাখ নগদ টাকা, ৫,৫০০ টন চাল, পাঁচ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, শিশুদের খাবারের জন্য দেড় কোটি টাকা এবং গোখাদ্যের জন্য দেড় কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।

বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন পৌনে ৩ কোটি মানুষ

ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে দেশের প্রায় পৌনে ৩ কোটি গ্রাহক। দেশের বিভিন্ন জায়গায় গাছপালা ভেঙে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গেছে। এসব কারণে এ খাতে ১০০ কোটি টাকার মতো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শুধু পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডেরই (আরইবি) প্রায় ২ কোটি ৭০ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ার কথা জানিয়েছে সংস্থাটি। রেমালের তাণ্ডবে আরইবির ক্ষতির পরিমাণ ৯১ কোটি ২০ লাখ টাকা আর ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) ক্ষতি ৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা।

সোমবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকার ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে রেমালের আঘাতে পোল নষ্ট হয়েছে ২ হাজার ৭১৮টি, ট্রান্সফরমার নষ্ট হয়েছে ২ হাজার ৩৬৩টি, স্প্যান (তার ছেঁড়া) ৭১ হাজার ৮৬২টি, ইন্সুলেটর ভাঙা ২২ হাজার ৮৮৬টি, মিটার নষ্ট হয়েছে ৫৩ হাজার ৪৬৫টি। এসবের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৯১ কোটি ২০ লাখ টাকা। ওজোপাডিকোর প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, পোল নষ্ট ২০টি, হেলে পড়া পোল ১৩৫টি, বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে গেছে ২৪.৩৪ কিলোমিটারের, ১১ কেভি পোল ফিটিংস বিনষ্ট হয়েছে ১৪২ সেটের, ট্রান্সফরমার বিনষ্ট ১২টি, ১১ কেভি ইন্সুলেটর বিনষ্ট ১৩৪টি। এসবের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা।

আরও পড়ুন  ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আর নেই

১৫ হাজার মোবাইল টাওয়ার বন্ধ

রেমালের তাণ্ডবে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বেশিরভাগ এলাকায় বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রভাব পড়েছে মোবাইল ফোনের সেবায়। বিদ্যুৎ না থাকায় এসব এলাকায় প্রায় ১৫ হাজার মোবাইল টাওয়ার বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল অপারেটরস অব বাংলাদেশ (এমটব) এ তথ্য জানিয়েছে। তারা জানিয়েছে, নেটওয়ার্ক দ্রুত ফিরিয়ে আনতে মোবাইল অপারেটররা বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করছে।

 বিপর্যস্ত বিমান পরিষেবা

ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে এবং বৈরী আবহাওয়ার কারণে দেশব্যাপী বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বিমান পরিষেবা। সোমবার হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে আন্তর্জাতিক রুটের ১১টি ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়াও শিডিউল বিপর্যয় ঘটেছে চারটি ফ্লাইটের। অবতরণের অন্য বিমানবন্দরে পাঠানো হয়েছে তিনটি ফ্লাইট। এ ছাড়া তিনটি ফ্লাইটের যাত্রীদের ভিন্ন ফ্লাইটে তুলে দেওয়া হয়েছে। শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম এসব তথ্য জানান।

তিনি জানান, বাতিল হওয়া ফ্লাইটগুলোর মধ্যে ভিস্তারা এয়ারলাইনসের দিল্লি ও মুম্বাই ফ্লাইট, ইন্ডিগোর কলকাতা, মুম্বাই, দিল্লি, কলকাতা ও চেন্নাই, এয়ার ইন্ডিয়ার দিল্লি এবং জাজিরা এয়ারওয়েজের কুয়েতগামী দুটি ফ্লাইট রয়েছে। আবহাওয়ার কারণে চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইনের কুনমিং এবং মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের কুয়ালালামপুরের ফ্লাইট নির্ধারিত সময় থেকে বেশ দেরিতে ছেড়েছে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী নভোএয়ারের একটি ফ্লাইট দুই ঘণ্টা উড়ে অবতরণে ব্যর্থ হয়ে আবার ঢাকায় ফিরে আসে বলেও জানান তিনি।

দুজনের মরদেহ উদ্ধার, শতাধিক গাছ অপসারণ

ঘূর্ণিঝড় রেমাল মোকাবিলায় কাজ করছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। ঝড় শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত দুজনকে মৃত এবং চারজনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা করেছে। সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত দুর্যোগপূর্ণ এলাকার রাস্তাঘাট এবং বিভিন্ন বাসাবাড়ির ওপর উপড়ে পড়া ১১৪টি গাছ অপসারণ করেছে ফায়ার সার্ভিস। এ ছাড়া দুর্যোগপূর্ণ বিভিন্ন ফায়ার স্টেশনে ১৬৩ জনকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর জানিয়েছে, চট্টগ্রামের চন্দননগরে উদ্ধার করা হয়েছে দেয়াল ধসে নিহত সাইফুল ইসলাম হৃদয়কে (২৬)। এ ছাড়া বরিশাল বিভাগের বাউফলে উদ্ধার করা হয়েছে গাছচাপায় নিহত মো. আব্দুল করিম খানকে (৬৫)। এসব এলাকা থেকে আহত দুজনকে উদ্ধার করে কাছাকাছি হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।

সর্বশেষ সংবাদ