বিদ্যুত বিপর্যয়ে নাকাল মানুষ

প্রকাশিত: ৭:১৫ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৪, ২০২২

বিদ্যুত বিপর্যয়ে নাকাল মানুষ

বিদ্যুত বিপর্যয়ে নাকাল মানুষ।

প্রভাতবেলা প্রতিবেদক,ঢাকা: ক্রমাগত লোডশেডিংয়ের অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে বাংলাদেশ। উৎপাদনক্ষমতা বাড়াতে গিয়ে হাজার হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র অব্যবহৃত রেখে মূল্য পরিশোধ করা হচ্ছে। মানুষ অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছে, কিন্তু সঞ্চালন লাইন ও বিতরণ লাইন না থাকায় উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে দেয়া যাচ্ছে না। গত দুই মাসে জাতীয় গ্রিডে দুবার বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছে। পুরো বিদ্যুৎ খাতকে দায়মুক্তি দেয়ার কারণে কোনো জবাবদিহির ব্যবস্থাও থাকছে না।
পাওয়ার সেলের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, গত ১৮ অক্টোবর নাগাদ বাংলাদেশের মোট স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা হলো ২৫ হাজার ৭৩০ মেগাওয়াট, যার আওতায় গত ১৪ এপ্রিল সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড রয়েছে। গত ১৭ অক্টোবর বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১২ হাজার ৭৭৩ মেগাওয়াট। এক বছর আগে অক্টোবর মাসের এ সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছিল ১৩ হাজার ৪৮২ মেগাওয়াট। এ এক বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির পরিবর্তে ৮০০ মেগাওয়াট কমে গেছে। সর্বোচ্চ উৎপাদন রেকর্ডের সাথে হিসাব করা হলে এখন গড়ে ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হচ্ছে।
সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে ব্যয়বহুল জ্বালানিনির্ভর উৎপাদন কেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে বলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে। প্রশ্ন হলো- কেন এ ধরনের ব্যয়বহুল জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়েছে?
পাওয়ার সেলের সর্বশেষ তথ্যানুসারে, ক্যাপটিভ পাওয়ার বাদ দিয়ে যে ২২ হাজার ৫১২ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে, তার মধ্যে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে ৫ হাজার ৯২৫ এবং ডিজেলভিত্তিক রয়েছে ১ হাজার ২৮৬ মেগাওয়াটের। এর বাইরে ১১ হাজার ৪৭৬ মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে স্পট মার্কেট থেকে জ্বালানি কিনে এসবের অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানো সরকারের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ অবস্থায় স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতার বড় অংশ যেখানে উৎপাদনে কাজে লাগানো যাচ্ছে না, সেখানে ভারত থেকে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি করা হয়েছে। এর বাইরে ভারতীয় কোম্পানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে নেপাল থেকে আরো কয়েক হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ আমদানির প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
পাওয়ার সেলের তথ্যানুসারে, ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতার বিপরীতে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ২৬৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছিল। আর পরবর্তী ৯ বছরে ২০ হাজার ৭৮৮ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধির বিপরীতে বাস্তবে উৎপাদন বেড়েছে ১১ হাজার ৫১৪ মেগাওয়াট। এ সময়ে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনুমতি দেয়ার চুক্তির অংশ হিসেবে এ পর্যন্ত লাখোকোটি টাকা বিদ্যুৎ না নিয়ে পরিশোধ করতে হয়েছে। এর মধ্যে ২০২২ সালের ৯ মাসে পরিশোধ করা হয়েছে ১৬ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।
কেবলই উৎপাদন, সঞ্চালন-বিতরণের খবর নেই। বিদ্যুৎ খাতে উৎপাদন বাড়লেই এর সুবিধা গ্রাহকের কাছে পৌঁছায় না। উৎপাদন কেন্দ্র থেকে সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিড এবং বিতরণ লাইনের মাধ্যমে তা গ্রাহকের কাছে পৌঁছাতে হয়। কিন্তু সরকার গত এক যুগের বেশি সময়ে কেবলই উৎপাদনের ওপরই জোর দিয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা বেড়েছে ৪২০ শতাংশ। আর একই সময়ে বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন বেড়েছে ১৪১ শতাংশ। সঞ্চালন লাইনের অবস্থা আরো করুণ। এ ১৩ বছরে সঞ্চালন লাইন বৃদ্ধি পেয়েছে ৭৩ শতাংশ। ফলে অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনে দিতে না পারায় প্ল্যান্ট বসিয়ে রেখে টাকা দিতে হয়েছে। আবার বিতরণ ব্যবস্থার ত্রুটি বা অপর্যাপ্ততার কারণে গ্রিডের বিদ্যুৎ বিতরণ করা যায়নি গ্রাহক পর্যন্ত। এভাবে জাতীয় সম্পদের রক্তক্ষরণ ঘটানো হয়েছে। আর সরকারের আনুকূল্যপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীদের রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে যে টাকা দেয়া হয়েছে, তা পুনর্ভরণের জন্য দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার এ অসামঞ্জস্যশীল বিকাশের কারণে বিদ্যুৎ খাতে এখন এমন এক অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, যার জন্য একদিকে বিদ্যুৎ না নিয়ে উৎপাদকদের বিল পরিশোধ করতে হয়েছে, অন্যদিকে গ্রাহক বিদ্যুৎ থেকে বঞ্চিত হয়ে লোডশেডিংয়ের অন্ধকারে থাকে।
সঞ্চালন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন না করার কারণে সর্বশেষ অক্টোবর মাসেই বিদ্যুৎ গ্রিড ট্রিপ করার কারণে রাজধানীসহ দেশের ৬০ শতাংশ এলাকা অন্ধকারে পড়ে যায় দীর্ঘসময়ের জন্য। অথচ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এ সময় পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রায় ৯শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ অব্যবহৃত থেকে যায়। এই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিদ্যুৎ অপর অংশের জাতীয় গ্রিডের সাথে সমন্বয় না হওয়ার কারণে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে অব্যবহৃত বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ প্রতিদিন ৫০ কোটি টাকা বিদ্যুৎ না নিয়ে পরিশোধ করতে হচ্ছে।
লোডশেডিং বাড়ছে উদ্বেগজনকভাবে। বাংলাদেশে এখন বিদ্যুৎ সরবরাহ দেশব্যাপী বড় মাত্রায় কমিয়ে দেয়া হয়েছে। সরকার বলছে, গ্যাস সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বিদ্যুতের লোডশেডিং করতে হচ্ছে। বিশ্ববাজারে দাম চড়া হওয়ায় খোলাবাজার বা স্পট মার্কেট থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি কেনা বন্ধ রাখার কথা বলা হচ্ছে।
দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে কয়েকদিন ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে কবে নাগাদ পরিস্থিতির উন্নত হতে পারে- সে ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারেননি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়।
দেশের উত্তরাঞ্চলের বগুড়ার পাশাপাশি রংপুর অঞ্চল, ঠাকুরগাঁও, রাজশাহীসহ উত্তরের বিভিন্ন জেলা থেকে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের ব্যাপকতার চিত্র পাওয়া গেছে। ময়মনসিংহ অঞ্চলের জেলাগুলোয়ও ঘন ঘন লোডশেডিং হচ্ছে। সিলেট এবং নোয়াখালী অঞ্চলে গ্রাহক তিন-চার ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। রাজধানী ঢাকায়ও বিভিন্ন এলাকায় মাসাধিককাল ধরে কয়েক ঘণ্টা ধরে লোডশেডিং হচ্ছে।
কর্মকর্তারা দাবি করেন, দেশে বিদ্যুতের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদনের সক্ষমতা তৈরি হওয়ায় চার বছর ধরে কোনো লোডশেডিং হয়নি। কিন্তু সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতে চাহিদার বিপরীতে সরবরাহে ১২০০ মেগাওয়াটের বেশি ঘাটতি হচ্ছে। বলা হচ্ছে, গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে দেয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক খোলাবাজার বা স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা হচ্ছে না। সেজন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানো হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি জ্বালানির বিশ্ববাজার পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, গ্যাসের দাম এখন আন্তর্জাতিক স্পট মার্কেটে প্রতি ঘনফুট ৩৬ ডলার হয়েছে। যেহেতু এ পরিমাণ টাকা দিয়ে গ্যাস আনা যাচ্ছে না, সেজন্য এ লোডশেডিংয়ের ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে।
গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ১০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে। এ কেন্দ্রগুলোয় এখন অর্ধেকেরও কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। এছাড়া কর্মকর্তারা বলছেন, জ্বালানি তেলের দামও বিশ্ববাজারে অনেক বেশি হওয়ায় পেট্রলিয়াম করপোরেশনকে দিনে ১০০ কোটি টাকার বেশি লোকসান দিতে হচ্ছে। সেজন্য তেল-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও পুরোদমে চালানো হচ্ছে না। এ অবস্থার সহসা উন্নতি সম্ভব কিনা- এমন প্রশ্নে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারেননি।
তার কথায় এটা পরিষ্কার, বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম কমার অপেক্ষায় থাকবে সরকার এবং এমুহূর্তে বিকল্প উপায় নেই।
পরিকল্পনার সাথে বা¯তবতার মিল নেই । বিদ্যুৎ খাতে সমস্যা সমাধানে বর্তমান সরকার স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করেছে। এছাড়া ২০৪১ সাল পর্যন্ত ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। সরকারের বিদ্যুৎ খাতে ২০১৬ সালের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। যেখানে আমদানি ও নিজস্ব গ্যাসে ৩৫ শতাংশ, আমদানিনির্ভর কয়লায় ৩৫ শতাংশ, তেল, বিদ্যুৎ আমদানি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বাকি ৩০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু এ পরিকল্পনার সাথে বাস্তবতার যে অনেক ফারাক রয়েছে, তা দেখা যায় পরিকল্পনার প্রক্ষেপণ এবং বাস্তবতায়। এ পরিকল্পনায় ২০২১ সালে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলা হয়েছিল এখন বাস্তবে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে এর অর্ধেক। অথচ এ পরিমাণ উৎপাদনের জন্য রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কোম্পানিকে বিদুৎ উৎপাদনের কাজ দেয়া হয়েছে। যার কারণে এ বছরের ৯ মাসে তাদের বসিয়ে রেখে ১৮ হাজার কোটি টাকা দেয়া হয়েছে।
মহাপরিকল্পনা অনুসারে ২০৩০ সাল নাগাদ বিদ্যুৎ উৎপাদন ৪০ হাজার এবং ২০৪১ সাল নাগাদ ৬০ হাজার মেগাওয়াট করার কথা বলা হয়েছে। এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন নির্মাণের কোনো পরিকল্পনা সেভাবে করা হয়নি। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনই করা হচ্ছে, কিন্তু তা ব্যবহারের কার্যকর কোনো ব্যবস্থা করা হচ্ছে না।
বিদ্যুৎ খাতকে সরকার মূলত ক্ষমতায় থাকার জন্য দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলোকে সুবিধা দেয়ার হাতিয়ারে পরিণত করেছে। ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার জন্য এক সমঝোতা করা হয়েছে। ২৫ বছরের মেয়াদে এই বিদ্যুৎ কিনতে সম্ভাব্য ব্যয় হবে এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় নেয়া উদ্যোগে আদানি পাওয়ার ঝাড়খণ্ড প্রদেশের গোড্ডা জেলায় এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেছে, যার বেশিরভাগই বাংলাদেশে রফতানি হবে।
অ্যান অ্যাকিলিস হিল অব দ্য পাওয়ার সেক্টর অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, ডিসেম্বর ’২২ পর্যন্ত চার মাসের ক্যাপাসিটি চার্জ হবে এক হাজার ২১৯ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে সই হওয়া চুক্তি অনুযায়ী, মোদির ঘনিষ্ঠ ভারতীয় উদ্যোক্তা আদানি গৌতম প্রতিষ্ঠিত আদানি গোড্ডা পাওয়ার প্ল্যান্টের ইউনিটপ্রতি ক্যাপাসিটি চার্জ তিন টাকা ২৬ পয়সা। তবে বাংলাদেশে একধরনের প্ল্যান্টের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দুই টাকা ৮৩ পয়সা।
বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এক্সটারনাল ডেট ও ভারতভিত্তিক গ্রোথওয়াচের এ যৌথ গবেষণায় বলা হয়, আদানি গোড্ডার বিদ্যুৎ আমদানিকৃত অন্যান্য বিদ্যুতের চেয়ে ৫৬ দশমিক ২, আমদানিকৃত কয়লা বিদ্যুতের চেয়ে ৩৬ দশমিক ৯ ও দেশীয় কয়লা বিদ্যুতের চেয়ে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি ব্যয়বহুল হবে। প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়েছে, চুক্তির ২৫ বছরের মেয়াদকালের মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে আদানি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি অর্থ দিতে হবে বাংলাদেশকে, যা তিনটি পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য যথেষ্ট। আর নতুন কয়লা প্ল্যান্ট নির্মাণের আনুমানিক খরচ প্রতি কিলোওয়াট তিন হাজার ৫০০ ডলার। এ হিসাবে আদানিকে সর্বোচ্চ পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহারের সময়ে গ্রিডে পর্যাপ্ত শক্তি নিশ্চিত রাখার জন্য বিদ্যুৎ না নিয়েই প্রদেয় মাশুল বা ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ যে অর্থ দেয়া হবে, তা দিয়ে ১৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশে নির্মাণ করা সম্ভব।
৯ মাসে বিদ্যুৎ না নিয়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা শোধ: বর্তমানে বাংলাদেশের গ্রিড বিদ্যুতের উৎপাদনক্ষমতা ২২ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন গত ১৬ এপ্রিল ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। গড় উৎপাদন গ্রীষ্মকালে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। শীতে কমে সাত থেকে আট হাজারে নেমে আসে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার একটা বড় অংশ বসে থাকে। বিদ্যুৎ না কিনলেও চুক্তি অনুসারে বেসরকারি কেন্দ্রগুলোকে একটা চার্জ দিতে হয়। গত ১৪ বছরে বিদ্যুতে এ ধরনের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এটি দিয়ে তিন হাজার মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করা সম্ভব।
২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ১৬ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে ১৩ হাজার ১৫৫ কোটি ২১ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৮৫২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এতে দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছরই ক্যাপাসিটি চার্জের এ অঙ্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিগত অর্থবছরে ৯ মাসে বিদ্যুৎ না নিয়ে যে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে, তার মধ্যে বেসরকারি খাতের আইপিপি ও সিআইপিপিকে দিতে হয়েছে, ৯ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে দিতে হয়েছে ১ হাজার ৭১৪ কোটি টাকা, আমদানিকৃত বিদ্যুতের জন্য দিতে হয়েছে ২ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা আর বাকিদের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে ৪ হাজার ২২২ কোটি টাকা।
বর্তমানে ভারত থেকে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করে বাংলাদেশ। এ বিদ্যুতের আমদানি ব্যয়ের ৪০ শতাংশই যায় ক্যাপাসিটি চার্জে। বিশেষ করে শীতকালে যখন চাহিদা কমে যায়, তখন আমদানি কমে আসে। বিদ্যুৎ কম এলেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। ২০১৩ সালে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হয়। চুক্তি অনুসারে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ভারতকে দেয়া ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ৫০০ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৯২১ কোটি টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৮৪০ কোটি, ২০১৬-১৭-তে ছিল ৬২৭ কোটি, ২০১৭-১৮-তে ৯৮৭ কোটি, ২০১৮-১৯-এ ১ হাজার ৫৫৩ কোটি এবং ২০১৯-২০ সালে ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল এক হাজার ৪৯২ কোটি টাকা; যা ২০২১-২২ অর্থবছরের ৯ মাসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকায়।
‘বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এক্সটারনাল ডেবট বা বিডব্লিউজিইডির গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৭টি বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে বছরের অধিকাংশ সময় অলস বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ১৩ হাজার কোটি টাকা দিতে হয়েছে; যা আগের বছরের চেয়ে ২১ শতাংশ বেশি।
বিডব্লিউজিইডির তথ্যানুসারে, ৬৫০০ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতাসম্পন্ন শীর্ষ ১২টি কোম্পানি আট হাজার কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে, যা ২০২০-২০২১ অর্থবছরে প্রদত্ত মোট ক্যাপাসিটি চার্জের ৬৬ দশমিক ৪ শতাংশ। এ তালিকার এক নম্বরে রয়েছে সামিট গ্রুপ। তাদের পরে পর্যায়ক্রমে রয়েছে এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল, ইডিআরএ পাওয়ার হোল্ডিং, ইউনাইটেড গ্রুপ, কেপিসিএল, বাংলা ট্র্যাক, ওরিয়ন গ্রুপ, হোসাফ গ্রুপ, মোহাম্মদী গ্রুপ, ম্যাক্স গ্রুপ, শিকদার গ্রুপ ও এপিআর এনার্জি।
বিশ্বব্যাপী বিশেষ প্রয়োজনে ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ কেন্দ্র অলস রাখা হচ্ছে আদর্শ নিয়ম। জাপানে ১০ শতাংশ অলস বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। এটা বেশি হলে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে অলস বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ। এসবের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে গিয়েই বিদ্যুৎ খাত দেউলিয়া হচ্ছে।
সরকারের ক্রান্তিকালে যেখানে দরকার ছিল প্রশাসন চালানোর ব্যয়ের লাগাম টানা, বিদ্যুৎ খাতের ক্যাপাসিটি চার্জের মতো অপখরচ থামানো, অপ্রয়োজনীয় রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তি বাতিল করা। সেটি না করে জ্বালানি আমদানি বন্ধ করে এখন জনগণের ওপর লোডশেডিং চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে।
প্রাথমিকভাবে তিন বছরের জন্য দেয়া লাইসেন্স ১৭ বছর পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধির অনুমতি পেয়েছে এ ধরনের কোনো কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এই সর্বনাশা পথের ইতি ঘটিয়ে পরিণামদর্শী বিদ্যুৎনীতি নেয়া হলে জ্বালানির জন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করার প্রয়োজন হবে না। এজন্য অফশোর ও অনশোরে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন নিশ্চিত করা আর সে সাথে দেশীয় কয়লা উত্তোলনের বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।

সর্বশেষ সংবাদ