সিলেট ২১শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৮ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ |
প্রকাশিত: ৬:০০ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১, ২০২৩
[ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী রাষ্ট্রনায়কদের অন্যতম। একই সাথে দেশে- বিদেশে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন সংগ্রামী এই নেত্রী। শেখ হাসিনার জীবন, কর্ম, বেড়ে উঠা, ঘাত -প্রতিঘাত নিয়ে অনেকটা স্মৃতিচারণমূলক সংকলিত প্রবন্ধ প্রভাতবেলা’য় মেইল করেছেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ ও প্রকাশনা বিভাগের উপ-পরিচালক খলিলুর রহমান ফয়সাল। সময়, প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা বিবেচনায় পাঠকদের জ্ঞাতার্থে প্রবন্ধটি প্রভাতবেলা’য় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে- সম্পাদক ]
আমি যখন যতবারই টুঙ্গিপাড়া গিয়েছি, গ্রামটাকে ঠিক গ্রামই মনে হয়েছে। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান কিংবা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মস্থান হলেও টুঙ্গিপাড়ায় তেমন বড় কোন ভবন নেই। খাল-বিলের জলের কিনারায় হিজল করচে ঘিরে থাকা বাংলার আদিম জনপদ যেন টুঙ্গিপাড়া। শেখ হাসিনা তাঁর ছোটবেলার কথা উঠলেই টুঙ্গিপাড়ার গ্রামের কাঁচা রাস্তায় সমবয়সীদের সাথে ঘুরে বেড়ানোর গল্প বলেন। মাছ ধরার জাল ‘ওচা’ দিয়ে তিনি গ্রামের অন্য বাচ্চাদের সাথে মাছ ধরতেন। গাছে উঠা, সাতার কাঁটা, অন্যের গাছ থেকে কাঁচা আম পেড়ে খাওয়ার মতো দুরন্তপনা শৈশব ছিলো তাঁর।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সেগুলো ছিল আমার জীবনের সেরা সময়’। বঙ্গবন্ধুর পাঁচ সন্তানের মাঝে শেখ হাসিনা ছিলেন সবার বড়। বড় সন্তানদের হতে হয় সমুদ্রের মতো বিশাল। পরিবারের বড় বড় দায়িত্বগুলো বড় সন্তানের কাঁধে এসে জুটে। বিভিন্ন লেখায় ছোট ভাই বোনদের প্রতি তাঁর পরম স্নেহের কথা আমরা বারবার পড়েছি। বাংলাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব কিভাবে আটপৌরে জীবন যাপন করেন, তা আমরা শেখ হাসিনাকে দেখে শিখি। ক’দিন আগেও আমরা তাঁকে টুঙ্গিপাড়ায় ভ্যানে চড়ে গ্রাম ঘুরতে দেখেছি।
আবার সারা বিশ্বের তাবৎ পরাক্রমশালী নেতাদের সাথেও শেখ হাসিনাকে আমরা চোখে চোখ রেখে কথা বলতে দেখতে পাই। কমনওয়েলথ সম্মেলনে প্রয়াত ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথ বাকিংহাম প্যালেসে শেখ হাসিনাকে খুঁজে না পেয়ে বলেছিলেন, “হাসিনা কোথায়, ওকে দেখছি না কেন!” বলাবাহুল্য বাংলাদেশ এখন সারা বিশ্বের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। টুঙ্গিপাড়ার ‘আলসেখানা’র সেই সাধারণ মেয়েটি কীভাবে এক পৃথিবী শোক কাটিয়ে, শত্রুর সব রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, বারবার ঘাতকের গ্রেনেড ও বুলেট এড়িয়ে, অন্ধকারের অতল গহবর থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে আলোর পথে নিয়ে আসলেন। কেমন ছিলো তাঁর এই পথচলা?
স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের বিশ্বস্ত সহচর, অকৃত্রিম সুহৃদ তাজউদ্দীন আহমদ কিছুটা ষড়যন্ত্রে, কিছুটা অভিমানে দ‚রে সরে গেলে বঙ্গবন্ধু ব্যথিত হয়েছিলেন। শেখ হাসিনা পিতাকে কিছুটা সান্ত¡নার সুরে একদিন বলেছিলেন, মোশতাক কাকা তো আছেন। বঙ্গবন্ধু উত্তরে বলেছিলেন, তুই মোশতাককে চিনিস? ও যে কোনো সময় আমার বুকে ছুরি চালিয়ে দেবে। সত্যিই সত্যিই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিপথগামী আর্মিদেও বুলেটে ক্ষত বিক্ষত হয় বঙ্গবন্ধুর হিমালয় সমান শরীর। মোশতাক গংরাও বসে যায় ক্ষমতার মসনদে।
শেখ হাসিনার স্বামী প্রতিথযশা বিজ্ঞানী এম. ওয়াজেদ মিয়ার গবেষণার কারণে পঁচাত্তরের ৩০ জুলাই জার্মানিতে যান শেখ হাসিনা; তার সঙ্গে ছোট বোন শেখ রেহানাও সেখানে যান বেড়াতে। ১৫ আগস্ট তারা সবাই ছিলেন বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের বাসায়। এদিন সকালে তাদের প্যারিস যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আগের দিন (১৪ আগস্ট) গাড়ির দরজায় ড. ওয়াজেদ মিয়ার হাতে চাপা লাগে, ফলে তারা ওই অবস্থায় প্যারিসে যাবেন কি না, এ নিয়ে ভাবছিলেন।
১৫ আগস্ট ভোর ৬টার দিকে ওয়াজেদ মিয়ার ঘুম ভাঙে সানাউল হকের স্ত্রীর ডাকে। জার্মানির বন থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশিদ চৌধুরী ফোন করেছেন, তিনি জরুরি কথা বলতে চান ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে। হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলার জন্য ওয়াজেদ মিয়া স্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাঠিয়ে দেন। কিছুক্ষণ পর শেখ হাসিনা ফিরে এসে জানান, হুমায়ূন রশিদ চৌধুরী ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে কথা বলতে চান। টেলিফোন ধরতে ওয়াজেদ মিয়া দ্রুত নিচে নামেন। তখন সেখানে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় মাথা নিচু করে পায়চারি করছেন সানাউল হক। ওয়াজেদ মিয়া ফোন ধরতেই অন্যপ্রান্ত থেকে রাষ্ট্রদ‚ত হুমায়ূন রশিদ চৌধুরী বলেন, ‘আজ ভোরে বাংলাদেশে ক্যু হয়ে গেছে। আপনারা প্যারিস যাবেন না। রেহানা ও হাসিনাকে এ কথা জানাবেন না। যতদ্রূত সম্ভব আপনারা সবাই আমার এখানে চলে আসুন।’
সানাউল হক যখন শুনলেন ঢাকায় সেনা বিদ্রোহ হয়েছে এবং বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন, সেই মুহর্ত থেকেই তিনি শেখ হাসিনা, রেহানা এবং ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে বৈরী আচরণ শুরু করেন এবং কোনো প্রকার সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি সবাইকে যত দ্রæত সম্ভব বাসা থেকে চলে যেতে বলেন। বাসা থেকে বের হওয়ার জন্য গাড়িটা পর্যন্ত দিতে অস্বীকৃতি জানান। যদিও বঙ্গবন্ধু এই সানাউল হককে রাজনৈতিক বিবেচনায় বেলজিয়ামের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার পর ওয়াজেদ মিয়া যখন বাসার ওপরে যান তখন শেখ হাসিনা অশ্রæজড়িত কণ্ঠে ওয়াজেদ মিয়ার কাছে জানতে চান হুমায়‚ন রশিদ চৌধুরীর সঙ্গে তার কী কথা হয়েছে। ওয়াজেদ মিয়া জানান, রাষ্ট্রদূত চৌধুরী তাদের প্যারিস যাত্রা বাতিল করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জার্মানির বনে ফিরে যেতে বলেছেন। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দুজনই কাঁদতে কাঁদতে বলেন, নিশ্চয়ই কোনো দুঃসংবাদ আছে যেটি ওয়াজেদ মিয়া তাদের বলতে চাইছেন না। আর তখন তারা দুজন বলেন, প্যারিসের যাত্রা বাতিল করার কারণ পরিষ্কারভাবে না বললে তারা বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও যাবেন না। বাধ্য হয়ে ওয়াজেদ মিয়া বলেন, ‘বাংলাদেশে কী একটা মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেছে, এ জন্য আমাদের প্যারিস যাওয়া যুক্তিসংগত হবে না।’
এ কথা শুনে তারা দুই বোন কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের কান্নার শব্দে শেখ হাসিনার সন্তান জয় ও পুতুলের ঘুম ভেঙে যায়। পাকিস্তান-মার্কিন চক্র বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার যে ‘ ব্লু প্রিন্ট’ তৈরি করেছিল, এর বাইরে ছিলেন না তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ওই সময় তারা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। ওইদিন তারা ঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পেলেও বিদেশে তাদের হত্যা করতে চক্রান্তকারীদের ‘প্ল্যানিং সেল’ ছিল বেশ তৎপর। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার অন্যরকম একটি জীবন শুরু হয়।
পিতামাতাসহ গোটা পরিবার হারিয়ে একটি সংগ্রামী যাত্রায় যেনো নেমেছেন এই দুই বোন। চারদিকের শত্রু গিজগিজ করছে, সুযোগ পেলেই তাঁদের হত্যা করা হবে। পিতা শেখ মুজিবকে হত্যার পর পৃথিবীর কোথাও যেন তাদের জায়গা হচ্ছিলো না। শেষ পর্যন্ত তাঁরা কোনও মতে জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর কাছে পৌঁছেছিলেন। সেখানে যাওয়ার আধঘণ্টার মধ্যেই যুগোশ্লাভিয়া সফরে আসা বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডক্টর কামাল হোসেনও সেখানে পৌঁছান। ( চলবে)
খলিলুর রহমান ফয়সাল, উপ-পরিচালক, জনসংযোগ ও প্রকাশনা বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
সম্পাদক : কবীর আহমদ সোহেল
নির্বাহী সম্পাদক: মোঃ আব্দুল হক
ঢাকা অফিস : ২৩৪/৪ উত্তর গোড়ান, খিলগাঁও, ঢাকা ।
সম্পাদক কর্তৃক প্রগতি প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং লিঃ, ১৪৯ আরামবাগ, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।
সিলেট অফিস: ২৩০ সুরমা টাওয়ার (৩য় তলা)
ভিআইপি রোড, তালতলা, সিলেট।
মোবাইল-০১৭১২-৫৯৩৬৫৩, ০১৭১২-০৩৩৭১৫
E-mail: provatbela@gmail.com,
কপিরাইট : দৈনিক প্রভাতবেলা.কম
আমাদের সর্ম্পকে গোপনীয়তা যোগাযোগ
Design and developed by ওয়েব হোম বিডি