সিলেট ৩১শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ |
প্রকাশিত: ৪:৪৩ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৯, ২০১৭
এনামুল হক: বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে শুধু পানি আর পানি । দু চোখ যে দিকে যায় পানির ঢেউ আর বাতাশ। মাঝে মাঝে হঠাৎ দেখা যায় সারি সারি বৃক্ষরাজি । পানিই যেন জীবন,পানিই যেন নিত্য দিনের সঙ্গী । এটি কোন সাগরের পারের বর্ননা নয়। বলছিলাম ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ খ্যাত টাঙ্গুয়ার হাওর এর কথা ।
প্রকৃতি প্রেমীরা হিজল,করচ আর নীলা জলের গভীর মিতালীর সাথে রাঙ্গাতে ছুটে আসছেন সীমান্ত ঘেষা এই অঞ্চলে । যেন শিল্পীর আঁকা যাদুর ছবির মতো নিশ্চল ছবির মত এক সৌন্দর্য ।
সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলায় অবস্থিত এই হাওর বাংলাদেশের অন্যতম আকর্ষনীয় নয়নাভিরাম সৌন্দর্য মন্ডিত জলাশয় ।
যেন এডভ্যাঞ্চার এরিয়া । বাংলাদেশ সরকার এ হাওরকে মৎস অভয়ারন্য আবার পর্যটন এরিয়া হিসেবে ঘোষনা করেছে।
এই অঞ্চল পর্যটকদের কাছে যেমন দিন দিন হয়ে উঠছে আকর্ষনীয় ও উপভোগ্য তেমনই স্থানীয়দের কাছে কখনো কখনো বিষফোড়া হয়ে দেখা দিয়েছে । এমনটি স্থানীয়দের ভাষ্য।
সম্প্রতি টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমন করে স্ব-চক্ষে দেখে এসেছি হাওর পারের মানুষের জীবনচিত্র। সমস্যা সম্ভাবনার অন্তরালে চলছে স্থানীয় বসবাসকারী মানুষের জীবন। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে,ডিজিটাল হচ্ছে মানুষের জীবনচিত্র। আশার দিক হলো তাহিরপুর অঞ্চলের সড়ক যোগযযোগের অভাবনীয় উন্নয়ন হয়েছে । এ কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা । কিন্তু পরিবর্তন হয়নি হাওর পারের মানুষের জীবনমান । পানির সাথে বসবাস,পানির সাথে সংগ্রাম আর পানিই যেন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ এই মানুষগুলির । আজও অবহেলিত,বঞ্চিত, দুঃখ দূর্দশাগ্রস্থ মানুষের নিরব কান্না যেন হাওরের ঢেউয়ের মত উতাল ।
তাহিরপুর বাজার, টাঙ্গুয়ার হাওর আর ট্যাকেরঘাটের বেশ কয়েকজন বাসিন্দা ও ব্যাবস্য়ীদের সাথে কথা বলে ফুটে এটেছে বর্তমান চিত্র ।
শিল্প সংস্কৃতি,পর্যটন সব দিক থেকে সম্ভাবনাময় হলেও মানুষের জীবন মান উন্নযনে আজও নেই কোন ভৃমিকা । হাওর পাড়ের মানুষের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস ফসল । কিন্তু বিগত ৩/৪ বছর ঐ অঞ্চলের মানুষ কোন ফসল ঘরে তুলতে পারেননি । আর এবারের আগাম বন্যা ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে ঠেলে দিয়েছে। নিঃস্ব নিস্ফল অসহায় মানুষগুলির ঘরে ঠিক মত খাবার জুটানো কঠিন হয়ে পড়েছে ।
স্থানীয় এক মুদি দোকানী হতাশার সুরে আবেগপ্রবন হয়ে কথা বলেন আমাদের সাথে । জানালেন, এই এলাকার মানুষের জীবিকা নির্বাহের আরেক মাধ্যম মৎস্য আহরণ । কিন্তু যে হাওরের পানির সাথে সংগ্রাম করে তাদের বেচে থাকতে হয় সে হাওরে মাছ ধরার অধিকার তাদের নেই । দুঃখের সাথে তারা জানালেন, সরকার মৎস্য অভয়ারন্য ঘোষনা করার পর টাঙ্গুয়ার হাওরে মাছ ধরা সম্পূর্ন নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু দেখা যায় রাতের আধারে হাওরে জ্বলে উঠে ছোট ছোট বাতি । অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় পাহারাদারদের আর্থিক সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে কিছু কিছু জেলে মাছ ধরার সুযোগ লাভ করে । তবে সবাই তো আর আর্থিক সুবিধা দেওয়ার সামর্থ্য নেই । ফসল নেই, মাছ ধরা বন্ধ এমন পরিস্থিতিতে নিরব হাহাকার চলছে হাওর পাড়ের মানুষের মাঝে ।
সারাদিন হাওরের মাঝে নৌ ভ্রমন ও ট্যাকেরঘাট থেকে শেষে সন্ধ্যায় তাহিরপুর বাজারে নাস্তা খাওয়ার জন্য রেষ্টুরেন্টে খোঁজতে গিয়ে মানসম্পন্ন কোন রেষ্টুরেন্ট না পেয়ে আমরা যখন হতাশ হলাম তখন আরেক স্থানীয় বাসিন্দা মুখ ফুটে অনেক গুলি কথা শুনালেন আমাদের । সারা দিনের আনন্দ যেন নিমিষেই ফুরিয়ে গেল আমাদের । জানালেন, ঐ এলাকায় সম্প্রতি চুরি,ডাকাতির প্রবনতা বৃদ্ধি পেয়েছে । ফসল নেই,মাছ ধরা বন্ধ, ব্যাবসা করার পুজিও নেই, আর ট্যাকেরঘাট কয়লা খনি চলে গেছে সিন্ডকেটের হাতে ।
হাওরের অদূরে দ্বীপ এলাকার মত ভেসে উঠা ছোট ছোট চরে কয়েকটি ঘরবাড়ি নিয়ে রয়েছে একেকটি মহল্লা । নেই শিক্ষা গ্রহনের কোন সুযোগ । প্রতিটি চরের সাথে এককটি ট্রলারে ভাসমান স্কুল তৈরী করেছে ব্্র্যাক । নাম দিয়েছে ” ব্র্যাক শিক্ষা তরী” । বিভিন্ন এনজিও সংস্থা ঐ এলাকার অবহেলিত মানুষের উন্নয়নে কাজ করছে ।
সম্প্রতি সরকার কর্তৃক টাঙ্গুয়ার হাওরকে পর্যটন এলাকা ঘোষনা করায় খুশিই হয়েছেন হাওর পারের মানুষ । তারা জানালেন, আপনারা দুর দূরান্ত থেকে আমাদের এলাকায় আসছেন, আমাদের কাছে পন্য ক্রয় করছেন, আমাদের ব্যাবসা ভাল হচ্ছে । পর্যটকরা যত বেশি আসবেন তত আমাদের এলাকা উন্নত হবে ।
এলাকার মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেল, সম্ভাবনার হাতছানি থাকার পরও অগ্রযাত্রার পথে প্রধান অন্তরায় । তারা জানালেন, স্থানীয় সম্পদশালী বা উদ্যোক্তা পর্যায়ের মানুষ প্রায় সবাই সুনামগঞ্জ বা সিলেট শহরে বসবাস করেন । প্রচুর সম্ভাবনা,নদী পথ আর সড়ক পথের অপূর্ব সমন্বয় এরপর অতি কম পারিশ্রমিকে শ্রমিক থাকার পরও গড়ে উঠছেনা কোন শিল্প কারখানা । নেই সরকারী বেসরকারী উদ্যোগ । হাওর পাড়ের মানুষগুলি যে তিমিরে ছিলেন আজও সে তিমিরেই রয়ে গেছেন । তাদের হাহাকার আর নিরব কান্না হাওরের ঢেউয়ের মত বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে । কিন্তু শোনার যে কেউ নেই ।
৮ নভেম্বর শুক্রবার আমরা গিয়েছিলাম হাওরপারের মানুষের কাছাকাছি সারাদিন টাঙ্গুয়ায় ঘুরে বেড়ানো, উচু ওয়াচ টাওয়ার থেকে হাওর দেখা আর ফটো সেশন শেষে বিকালে নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের ঐতিহাসিক ট্যাকেরঘাট নীলাদ্রী ভ্রমন ।
ঐতিহাসিক ট্যাকেরঘাট । যেখানে ছিল মহান মুক্তি যুদ্ধেও সাব সেক্টর । মেঘালয়ের পাদদেশে রয়েছে লেক ও লাল মাটির রাস্তা । আর পাশেই সবুজ ঘাস সমৃদ্ধ উচু নিচু টিলা সদৃশ্য । দেখলে মনে হয় যেন কেই ঘাসের কার্পেট বিছিয়ে রেখেছে । একদিকে পাহাড় অপরদিকে হাওর, মাঝখানে লেক আর রাস্তা যেম এক সবুজের সমারোহ । যাকে পর্যটকরা নাম দিয়েছেন ”নিলাদ্রী”।
ঐতিহাসিক সাক্ষী হিসেবে সেখানে নির্মত হয়েছে শহীদ মিনার । যখন সন্ধ্যা নামতে শুরু হলো, লালিমা সূর্য তখন পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ছে আমাদের ট্রলার ছুটে চলেছে তাহিরপুরের উদ্দেশ্যে । তাহিরপুর বাজার থেকে মোটর সাইকেল যোগে আবার পথচলা শুরু হলো সুনামগঞ্জ শহরের উদ্দেশ্যে । পথিমধ্যে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার পলাশ বাজারে যাত্রা বিরতিতে হলো গাভীর দুধের তৈরী মজাদার চা চক্র । এবার ফেরার পালা । শীতের আগমনী বার্তার শীতল বাতাসের ছোয়ায় আবারও মোটর সাইকেলের চাকা ঘুরলো । অবশেষে হাওর পাড়ের মানুষের বার্তা নিয়ে আমরা পৌছলাম নিজ নিজ গন্তব্যে । হাসি ফুটুক হাওর পারের অসহায় পিছিয়ে পড়া জনপদের মানুষের মাঝে । আপনিও ঘুরে আসুন টাঙ্গুয়া।
লেখক- সাংবাদিক

সম্পাদক : কবীর আহমদ সোহেল
নির্বাহী সম্পাদক: মোঃ আব্দুল হক
ঢাকা অফিস : ২৩৪/৪ উত্তর গোড়ান, খিলগাঁও, ঢাকা ।
সম্পাদক কর্তৃক প্রগতি প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং লিঃ, ১৪৯ আরামবাগ, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।
সিলেট অফিস: ২৩০ সুরমা টাওয়ার (৩য় তলা)
ভিআইপি রোড, তালতলা, সিলেট।
মোবাইল-০১৭১২-৫৯৩৬৫৩, ০১৭১২-০৩৩৭১৫
E-mail: provatbela@gmail.com,
কপিরাইট : দৈনিক প্রভাতবেলা.কম
আমাদের সর্ম্পকে গোপনীয়তা যোগাযোগ
Design and developed by ওয়েব হোম বিডি
