কাঁদছে দিরাই-শাল্লা : শোকে স্তব্ধ হাওর জনপদ

প্রকাশিত: ২:০৫ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৭

আবু হানিফ চৌধুরী, দিরাই: বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুতে তার নির্বাচনী এলাকা দিরাই-শাল্লাসহ হাওরাঞ্চলে শোকের ছায়া নেমে পড়ে। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে দিরাই-শাল্লার আপামর জনসাধারণ। ভোর থেকেই পৌর শহরের আনোয়ারপুরস্ত তার নিজ বাসভাবনে দলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেনী পেশার লোকজন ভিড় জমাতে থাকেন। সবার চোখেই জল কারো মুখেই কোন কথা নেই, একটাই জিজ্ঞাসা কখন আসবে তাদের প্রিয় মানুষটির মরদেহ। উপজেলা পর্যায়ের নেতারা কর্মী সমর্থকদের শান্তনা দেয়ার চেষ্ঠা করছেন। কার্যালয় থেকে তাৎক্ষনিকভাবেই তিনদিনের শোক কর্মসুচির ঘোষনা করা হয়। চলছে অন্তস্ট্রিক্রিয়া সম্পাদনের সব প্রস্তুতি। আজ সোমবার হ্যালিকপ্টার যোগে ঢাকা থেকে সকাল সাড়ে ৯টায় সিলেট শহীদ মিনারে, ১১টায় সুনামগঞ্জ এবং দুপুর ১টায় শাল্লা উপজেলায় সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের পর মরদেহ নিয়ে আসা হবে তার জন্মস্থান দিরাইয়ে। দিরাই বালুর মাঠে দলীয় নেতাকর্মীসহ সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের পর বাসভবনের সামনে আন্তষ্ট্রিক্রিয়া সম্পাদন করা হবে বলে জানান, উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি এডভোকেট সোহেল আহমদ।
রোববার থেকে দিরাই উপজেলা আওয়ামীলীগ তিন দিনের শোক ঘোষনা করেছে বলে জানিয়েছেন দলের সহ-সভাপতি সিরাজ উদ দৌলা তালুকদার ও সাংগঠনিক সম্পাদক অভিরাম তালুকদার। তারা জানান, দলীয় কার্যালয়ে আওয়ামীলীগ,যুবলীগসহ অঙ্গসংগঠনের জরুরী সভার আহবান করা হয়েছে, সভায় উনার অন্ত্যষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করার বিষয়ে আলোচনা করা হবে। শোক কর্মসুচীর মধ্যে কালো ব্যাজ ধারন, কালো পতাকা উত্তোলন,শোক র‌্যালী, বিভিন্ন উপাসানা লয়ে প্রার্থনা করা হবে বলে জানান তারা। একই কর্মসুচীর কথা জানালেন শাল্লা উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আল-আমিন চৌধুরী। এদিকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মহিলা কলেজ,পলিটেকনিক ইনসটিটিউট ছুটি ঘোষনা করে শোক র‌্যালী করে ও সেন মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতি তার মৃত্যুতে মাকের্ট বন্ধ রেখে শোক পালন করছে।
হাওরের কাদা-জল মেখে হাওর জনপদে যাত্রা-নাটক মঞ্চে দাপিয়ে বেড়ানো দু:খু সেন থেকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বর্ণিল রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী হয়ে উঠেন। তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে সুরঞ্জিত সেনের রাজনীতির শুরু বামপন্থী সংগঠনে। সাম্যবাদী দর্শনে দীক্ষা নিয়ে ছাত্রাবস্থায় রাজনৈতিক জীবন শুরু করা এই নেতা সারাজীবন দাপটের সঙ্গেই চলেছেন।
রাজনৈতিক জীবনের কঠিনতম সময়ে কাউকে পাত্তা দিয়ে চলেননি সুরঞ্জিত। দুর্দান্ত সাহস দেখিয়ে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অর্জন করেছেন বহু সম্মান। তবে শেষ জীবনে রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি বেশ দুর্বল হয়ে পড়েন।
স্বাধীন দেশের প্রথম সংসদ সদস্যসহ চার দশকের বেশির ভাগ জাতীয় সংসদেই নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের সক্রিয় যোদ্ধা ছিলেন সুরঞ্জিত। একমাত্র বেসামরিক লোক হিসেবে তিনিই একমাত্র ব্যাক্তি ৫ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন।
সর্বশেষ চলতি নবম জাতীয় সংসদের দ্বাদশ অধিবেশনে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী কমিটিরও কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
১৯৩৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের আনোয়ারপুর গ্রামে জন্ম সুরঞ্জিতের। তার বাবা চিকিৎসক দেবেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ও মা সুমতি বালা সেনগুপ্ত। তিনি দিরাই মডেল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ৫ম শ্রেণী ও উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং সিলেট এম সি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে সন্মান ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ঢাকা সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।
দেশের এই প্রবীণ রাজনীতিক ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন।
সত্তরের ঐতিহাসিক প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগের বিজয়ের সময়ও ন্যাপ থেকে একমাত্র সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে দেশ বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সত্তরের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন অন্যতম কনিষ্ঠ সদস্য। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৯, ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বামপন্থী সুরঞ্জিত ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ১৯৯৪ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
তিনি মহাজোট সরকারের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আগে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ও আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সহধর্মিণী ড. জয়া সেনগুপ্ত একটি বেসরকারী সংস্থায় দায়িত্বশীল পদে কর্মরত আছেন। একমাত্র পুত্র সৌমেন সেনগুপ্ত একজন আইটি প্রকৌশলী, বর্তমানে একটি বেসরকারী কোম্পানিতে কর্মরত। স্থানীয়রা জানান, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শুধু একজন নেতাই ছিলেন না, আমাদের অভিভাবক ছিলেন, আমরা ঢাকার জিগাতলার (সুরঞ্জিত সেনের বাসভবন) বাসা নিজের বাসা হিসেবেই জানতাম, যেকোন কাজে যে কোন মুহুর্তে আমরা জিগাতলা ছুটে যেতাম। এলাকাবাসির সহযোগীতায় নিজ অর্থায়নে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নিজের নামে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মহিলা কলেজ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা ছাড়াও এলাকার অবকাটামো উন্নয়ন করে যান তিনি। স্থানীয়রা জানান, হাওরাঞ্চলের নারী শিক্ষা ও কারিগরী শিক্ষায় ওই প্রতিষ্ঠান দুটি গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা রাখবে।
দিরাই-শাল্লার অভিভাবক বিশিষ্ঠ পার্লামেন্টারিয়ান, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য সাবেক মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রোববার ভোর সাড়ে ৪টার দিকে ল্যাব এইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। শুক্রবার সুরঞ্জিত সেনগুপ্তনের ফুসফুসের সমস্যায় হঠাৎ শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নেওয়া হয়। পরে শনিবার শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি ঘটায় তাকে সিসিইউতে নেওয়া হয়। সেখানে সাড়ে ৪টার দিকে তিনি মারা যান। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুতে গভির শোক ও পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন, সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি সাবেক এমপি মতিউর রহমান, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাবেক সাংসদ নাছির উদ্দিন চৌধুরী, জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিষ্টার এনামুল কবির ইমন, জেলা পরিষদেও চেয়ারম্যান নুরুল হুদা মুকুট, সুনামগঞ্জ পৌরসভঅর মেয়র আইয়ূব বখত জগলু, দিরাই পৌরসভার সাবেক মেয়র ও পৌর আওয়ামীলীগের সভাপতি আজিজুর রহমান বুলবুল, জেলা পরিষদের সংরক্ষিত নারী সদস্য জেলা আওয়ামী মহিলালীগ নেত্রী ফারহানা ইয়াসমিন সীমা, ৮নং ওয়ার্ড সদস্য নাজমুল ইসলাম, দিরাই উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আছাব উদ্দিন সরদার, সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ রায়, সুনামগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ফজলে রাব্বি স্মরণ, ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান জিতু, শিবলী আহমেদ বেগ, রেজুয়ান খান, শাহজাহান কাজী প্রমুখ।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ