শব্দদানবের তাণ্ডবে নগরবাসী দিশেহারা

প্রকাশিত: ১১:৫৯ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৭

আহমদ মারুফ : নগরীতে শব্দ দূষণ ক্রমশ বাড়ছেই। পরিবেশ ও জীবনের জন্যে মারাত্মক হুমকি স্বরূপ শব্দ দূষণ ভয়াবহ আকারের রূপ নিয়েছে। গত ১০ বছরের ব্যবধানে নগরীতে শব্দ দূষণ বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। নীরব আবাসিক এলাকা হিসেবে পরিচিত এলাকাসমূহেই শব্দ দূষণ এরই মধ্যে ৭০ ডেসিবেলের ওপর পৌঁছেছে। শব্দের তীব্রতায় মানুষের নাক, কান ও গলায় নানা রকম জটিল উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। একই কারণে মানুষের আচরণে রুক্ষতা ও মেজাজের ভারসাম্যহীনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। শব্দ দূষণ রোধে আইন থাকলেও পরিবেশ অধিদপ্তর, পুলিশ ও বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ আইনের প্রয়োগের ব্যাপারে উদাসীন।
যানবাহনের তীব্র হর্ণ, সিডি-ভিসিডি ও ক্যাসেটের দোকান থেকে ভেসে আসা সুরধ্বনি, ভবন নির্মাণের খট্খট্ শব্দ, ওয়ার্কশপের কর্কশ ধ্বনি, পাড়া-মহল্লায় ওয়াজ মাহফিলের পাওয়ারফুল সাউন্ড সিস্টেম, রোগী বহনকারী এ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস ও র‌্যাবের কর্নভেদকারী সাইরেন নাগরিক জীবনকে অতীষ্ট করে তুলেছে। অপরদিকে নগরীর প্রতিটি বাণিজ্যিক আবাসিক এলাকায় নির্মিত হচ্ছে আকাশছোঁয়া ভবন। তাই দিনরাত চলছে উন্নয়ন কাজ, তৈরি হচ্ছে নানা মাত্রার শব্দ। ক্রাশার মেশিনের শব্দ সহ্যের মাত্রা ছাড়িয়ে তা জনগণের দুর্ভোগের কারণ হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
ইদানিং শব্দ দূষণের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে জেনারেটর। বিদ্যুৎ চলে গেলে একই সময়ে বিভিন্ন ধরনের জেনারেটর থেকে প্রচণ্ড শব্দের উৎপন্ন হয়। যা পথচারীদের প্রচণ্ড বিরক্তির উদ্রেগ করে ও অনাকাংখিত শব্দ দূষণ করে।
শব্দ দূষণ নগর জীবনের শান্তি ও নির্জনতা ক্রমশ কেড়ে নিচ্ছে। আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠছে বাণিজ্যিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফলে নির্জনতা ভেঙ্গে তৈরি হচ্ছে কোলাহল। বাড়ছে শব্দের মাত্রা। অফিস আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, মসজিদ, পার্ক, রেষ্টুরেন্ট, ওয়ার্কশপ, কোনখানেই শব্দের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে নেই। অথচ ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী পরিবেশ অধিদপ্তর আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, মিশ্র এলাকা, নীরব এলাকা, শিল্প এলাকা, ফিল্ম টিভি, স্টুডিও, হলরুম, থিয়েটার, অফিস ও লাইব্রেরি দোকান ও বেকারি, রেষ্টুরেন্ট ও ওয়ার্কশপ প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন স্থানের জন্য দিবা রাত্রিতে নির্দিষ্ট ডেসিবেল শব্দ মাত্রা নির্ধারণ করা থাকলেও কেউ তা মানছে না।
সিলেটে বাণিজ্যিক এলাকার চেয়ে বেশি মাত্রায় আবাসিক এলাকাগুলো এখন শব্দ দূষণের শিকার। বিভিন্ন ওয়ার্কশপ শব্দ দূষণের অন্যতম ক্ষেত্র। নগরীর যত্রতত্র গড়ে উঠেছে এসব ওয়ার্কশপ। নিত্য দিনের কাজের টুংটাং শব্দে প্রকম্পিত হচ্ছে আশ-পাশ। মানুষের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে যানবাহন। সৃষ্টি হচ্ছে অতিরিক্ত শব্দের।
এছাড়া হাসপাতাল, ক্লিনিক, মসজিদ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে ‘নীরবতা পালন করুন’ লেখা থাকলেও বাস্তবতা সম্পূর্ণ বিপরীত। নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না মাইক ব্যবহারের ক্ষেত্রেও। নগরীর রাজনৈতিক মোহনা হিসেবে পরিচিত কোর্ট পয়েন্ট ও রেজিষ্ট্রারি মাঠে অনুষ্ঠিত জনসভাগুলোতে ‘পাওয়ারফুল সাউণ্ড সিস্টেম’ ব্যবহার করে সভা সমাবেশ করা হয়। এতে আশ-পাশ এলাকা প্রকম্পিত হয়ে পড়ে। মারাত্মক শব্দ দূষণের কবলে পড়েন পার্শ্ববর্তী হাজার হাজার জনসাধারণ। বিঘিœত হয় স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড। বিভিন্ন মেলা, দিবস পালন, ওয়াজ মাহফিল, বিজ্ঞাপন, প্রচার প্রচারণার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে পাওয়ারফুল মাইক। তাই শব্দ দূষণের মাত্রা বাড়ছে এখান থেকেও।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী শব্দের স্বাভাবিক সহনীয় মাত্রা হচ্ছে ৪৫ ডেসিবেল। কিšু— নগরীর শাহজালাল উপশহরে বেশির ভাগ সময় শব্দের মাত্রা থাকছে ৯০ থেকে ১শ’ ডেসিবেল। এ অবস্থা এখন নগরীর অধিকাংশ এলাকায়। সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, নগরীতে যেসব গাড়ি চলাচল করে এদের হর্ন ১৪০ ডেসিবেলের উপরে। শব্দ দূষণ নগরবাসীর জন্য এখন এক ভয়াবহ পরিবেশ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শব্দ দূষণের কারণে শিশুদের মানসিক বিকাশ বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্তি শব্দ দূষণ একটা শিশুকে বেড়ে উঠার পূর্বেই তাকে বধিরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
‘ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ’ নামের একটি এনজিও সংস্থার গবেষণা থেকে জানা যায়, সিলেট মহানগরীতে শব্দ দূষণ এখন ভয়াবহ মাত্রায়। এ গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৯৯৭ সালের পরিবেশ ও বন সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের নির্ধারিত কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে ১শ’ মিটার দূরত্ব পর্যন্ত নিরব এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। এসব স্থানে মোটর গাড়ির হর্ন বাজানো এবং মাইকিং করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এসব এলাকায় শব্দের সহনীয় মাত্রা দিনে ৪৫ ডেসিবেল এবং রাতে ৩৫ ডেসিবেল থাকবে। কিন্তু সিলেট নগরীর এই সমস্ত নিরব এলাকায় বর্তমান শব্দের মাত্রা সহনীয় মাত্রা অপেক্ষা ২২ থেকে ৩৮ ডেসিবেল বেশি। বর্তমানে নিরব এলাকা, শিল্প এলাকা সর্বত্রই শব্দ দূষণের মাত্রা ভয়াবহ।
নগরীর শব্দ দূষণের দুঃসহ পরিস্থিতি সম্পর্কে ওসমানী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, শব্দ দূষণ এখন ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে। এর শিকার হচ্ছে নগরীর সকল স্তরের মানুষ। শব্দ দূষণ মানুষের স্নায়ুগুলো ধ্বংস করে দিচ্ছে। ক্রমাগত শব্দ দূষণের ফলে কানের টিস্যুগুলো আস্তে আস্তে বিকল হয়ে পড়ে। তখন সে আর স্বাভাবিক শব্দ কানে শুনতে পারে না। কানের মধ্যে সব সময় এক ধরনের অস্বাভাবিক শব্দ হতে থাকে। ডাক্তারি ভাষায় এটাকে ‘টিনিটাস’ বলে। কানের যন্ত্র নিয়েও সে ভালো শুনতে পারে না। শব্দ দূষণ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে শিশুদের। হঠাৎ গাড়ির শব্দে তারা লাফিয়ে উঠছে এবং তাদের মধ্যে এক ধরনের সাইকোলজিক্যাল সমস্যা তৈরি হচ্ছে। তারা মানসিকভাবে ভীতু হয়ে পড়ছে। এতে করে শিশুর মানসিক বিকাশ বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। শব্দ দূষণের কারণে মনসংযোগের মারাত্মক বিঘœ ঘটে। এ জন্য শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্রমাগত সব ধরনের উচ্চ শব্দই মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এর মধ্যে যানবাহনের শব্দ বেশি ক্ষতি করছে। হাইড্রোলিক হর্ন হৃদরোগীদের মৃত্যুঝুকি ও উচ্চ রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। শিশুরা খিঁচুনি রোগে আক্রান্ত হতে পারে এবং সারা জীবনের জন্য বধির হয়ে যেতে পারে। এছাড়া ক্রমেই ইন্দ্রিয়শক্তি লোপ পেয়ে শিশু মানসিক প্রতিবন্ধীও হয়ে যেতে পারে। বর্তমানে রাস্তায় অধিকাংশ গাড়িতে যে হর্ণ ব্যবহৃত হচ্ছে সে সমস্ত হর্ণের শব্দ ১৪০ ডেেিসবেলের বেশি। কিছু কিছু গাড়িতে ডাবল হর্ণও ব্যবহার করা হচ্ছে। এ নিয়ে বিআরটিএ কিছু বলে না। হাসপাতাল, আবাসিক এলাকা এবং শিশুদের স্কুলের সামনে হর্ণ বাজানো নিষেধ থাকলেও গাড়ির চালকরা এসব নিরব এলাকাতেও অবলীলায় হর্ণ বাজাচ্ছে।
তারা বলেন, শব্দ দূষণের উৎস কেবল রাজপথে তা নয় প্রতিটি ঘরে ঘরে এর বিস্তার শুরু হয়েছে। উচ্চ স্বরে কথা বলা থেকে শুরু করে বৃহৎ শিল্প কারখানা সবই শব্দ দূষণের উৎস। গাড়ির হর্ণের আওয়াজ ৮০ ডেসিবল হওয়াই স্বাভাবিক। বিশ্বের অনেক দেশে গাড়ির হর্ণ বাজানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই সব উন্নত দেশের শহরগুলোতে আরো বেশি যানবাহন থাকা সত্ত্বেও উচ্চ শব্দের কোন বিপদ নেই। সিলেট সিটিকে শব্দ দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। শব্দের মাত্রাকে কিভাবে সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায় সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা কর্তব্য। নতুবা সময়ের ব্যবধানে শ্রীভূমি সিলেট রাজধানী ঢাকার মতো দূষিত নগরীতে পরিণত হবে।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ