আখেরী মোনাজাতে ১৫ লক্ষাধিক মানুষের অংশগ্রহণ

প্রকাশিত: ১২:০৮ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৬

মো. রেজাউল হক ডালিম: আজ ৩১ ডিসেম্বর সকাল ১১ টা ৫৬ মিনিটে আখেরি মুনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হলো ৩ দিন ব্যাপী তাবলীগ জামায়াতের বৃহৎ আয়োজন। ৩২ বছর পূর্বে দক্ষিণ সুরমার পলিটেকনিক মাঠে জেলা পর্যায়ে একটি ইজতেমা হয়েছিল। আখেরী মোনাজাতে কেবল ইজতেমা স্থলে ১৫ লক্ষাধিক মানুষ অংশ গ্রহণ করেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাছাড়া দুর দুরান্তে যতদুর আওয়াজ শোনা যায় ততদুর পযন্ত নারী পুরুষ যে যেখানে ছিলেন সেখান থেকেই মোনাজাতে অংশ নেন। বাংলাদেশ সহ মুসলিম উম্মাহর সুখ সমৃদ্ধি ও শান্তি কামনা করা হয় মোনাজাতে।

৩২ বছর আগে এরকম আরো একবার এ মহান গৌরব অর্জন করার সৌভাগ্য হয়েছিলো সিলেটবাসীর। এর প্রায় ৩ যুগের কাছাকাছি সময়ে এসে আবারও সিলেটবাসীর সে বিশাল পূণ্যময় অর্জন। সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার মোল্লারগাঁও ইউনিয়নের সুনামগঞ্জ বাইপাস সড়ক সংলগ্ন বিশাল মাঠে গত ২৯ ডিসেম্বর শুরু হয় সিলেটের ইজতেমা।
জানা গেছে, প্রতি বছর অনুষ্ঠিত টঙ্গি তুরাগ তীরের বিশ্ব ইজতেমার চাপ কমাতে এবং মুসল্লিদের সুবিধার্থে তাবলীগ জামায়াতের শীর্ষ মুরুব্বিদের নতুন সিদ্ধান্তের বদৌলতে এবার সিলেটে অনুষ্ঠিত হচ্ছে জেলাভিত্তিক ইজতেমা। তবে ইজতেমাটি জেলাভিত্তিক হলেও বয়ান পেশ করেছেন ভারত, সৌদি আরব ও ঢাকার কাকরাইল মসজিদের তাবলিগ জামায়াতের বেশ কয়েকজন মুরুব্বি। বিশ্ব ইজতেমার নিয়মিত বক্তারাই সিলেটের এই ইজতেমায় বয়ান রাখছেন। এদিকে, সিলেট ছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মুসল্লিদের সমাবেশ ঘটেছে সিলেটে অনুষ্ঠিত এ ইজতেমায়।
ইজতেমায় অংশগ্রহণকারী মুসল্লি এবং আয়োজক কমিটি সূত্রে জানা গেছে, ২৯ ডিসেম্বর থেকে ইজতেমার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরুর কথা থাকলেও ২/১দিন আগ থেকেই সিলেটের প্রত্যন্ত উপজেলা এবং মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলা থেকে হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মানুষ ইজতেমা ময়দানে জড়ো হতে থাকেন। বিশেষ করে আগের দিন অর্থাৎ ২৮ ডিসেম্বর বাস, ট্রাক, লেগুনা, মাইক্রোবাস ভাড়া করে আসতে থাকেন দলে দলে দুরের মুসল্লিরা। স্থান নেন ইজতেমা পেন্ডালের ভেতরে নামোল্লেখিত নির্ধারিত স্থানে। ২৯ ডিসেম্বর ফজর নামাজের পর আম বয়ানের মধ্য দিয়ে ইজতেমার মূল কার্যক্রম শুরু হয়। চলতে থাকে ধারাবাহিক অধিবেশন ও কার্যক্রম। এদিকে সকাল-দুপুর-রাত অবধি আসতে থাকে ইজতেমা মাঠ অভিমুখে বাঁধ ভাঙা মুসল্লি¯্রােত। ২৯ ডিসেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত ইজতেমা ময়দানে ৫ লক্ষাধিক মুসল্লির সমাগম ঘটে বলে আয়োজক কমিটি জানায়।
এদিকে শুক্রবার সরকারি ছুটি হওয়ায় ভোর থেকেই ইজতেমামুখি ধর্মপ্রাণ জনতার ঢল নামতে থাকে। সিলেটের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ জামায়াতের সাথে পবিত্র জুম্মার নামাজ আদায়ের মহৎ লক্ষে সারা সিলেটের মানুষ যেন উপচে পড়েন মোল্লারগাঁও ইউনিয়নের লতিপুর, খিদিরপুর মাঠে। জন¯্রােত বাড়তে থাকলে সকাল ৯টার দিকে দক্ষিণ সুরমার তেতলীস্থ সুনামগঞ্জ বাইপাস সড়কের প্রবেশমুখ এবং উল্টোদিকের রেলক্রসিং থেকে ময়দানমুখি সব ধরনের গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। পরবর্তীতে উভয় দিকে ৪ কিলোমিটার বাইপাস সড়ক পায়ে হেঁটে মুসল্লিরা যেতে থাকেন ইজতেমা ময়দানের দিকে এবং অংশগ্রহণ করেন জুম্মার নামাজে। একসময় মাঠ ভর্তি হয়ে পায়ে হাটার পথও বন্ধ হয়ে গেলে আগত মুসল্লিরা বাইপাস সড়কে এবং তারও পুর্ব পাশ্বে কাতারবন্দি হয়ে জুম্মার নামাজ আদায় করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী জুম্মার নামাজে ১০ লক্ষাধিক মুসল্লির সমাগম ঘটে।
অন্যদিকে, সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উজেলার মোল্লারগাঁও ইউনিয়নে ইজতেমার মাঠ হওয়ায় দক্ষিণসুরমাবাসী বিষয়টিকে বিশাল একটি পূণ্যময় অর্জন মনে করছেন। দক্ষিণ সুরমার সর্বস্থরের ধর্মপ্রাণ মানুষের বক্তব্য- তাদের প্রতি হয়তো আল্লাহর বিশেষ রহমত নাজিল হওয়ার লক্ষণ হিসেবেই এ মাঠ নির্ধারিত হয়েছে। এছাড়াও নজিরবিহীন এ আয়োজনে আপ্লুত সমগ্র সিলেটবাসী। ইজতেমায় আসা মুসল্লিদের অনেকেই জানান, আল্লাহ বিশেষ মায়ার নজরে না তাকালে এতো বড় দ্বিনী মজমুআ সিলেটের মাটিতে হতো না।
আয়োজক কমিটি সূত্রে জানা গেছে, আগত মুসল্লিদের যাতে কষ্ট না হয়, সেজন্য বিশাল আকারে টানানো হয়েছে প্যান্ডেল। পেন্ডালের ভেতরে রয়েছে ১১টি খিত্তা। এছাড়া মাঠের দক্ষিণ পাশে ৫ থেকে ৬ হাজার মুসল্লি যাতে একসঙ্গে অজু করতে পারেন সেজন্য রয়েছে বিশাল অজুখানা। এই অজুখানা ছাড়াও আরও ৩৫ থেকে ৪০টি ছোট অজুখানার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাঠের চতুর্পাশ জুড়ে প্রায় ২ হাজার শৌচাগার রয়েছে। বসানো হয়েছে ৫টি গভীরসহ ১৫টি নলকূপ।
সিলেটের জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ইজতেমার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করা হয়েছে। নলকূপ বসানো, বিদ্যুতের ব্যবস্থা, রাস্তা করা এবং রাস্তার উন্নয়নসহ অধিকাংশ কাজে জেলা প্রশাসন সহযোগিতা করেছে। মুসল্লিরা যাতে সুন্দরভাবে ইজতেমায় অংশ নিতে পারেন, সেজন্য পুলিশ প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসন সার্বিক দিকে দৃষ্টি রাখছে।
সিলেট সিটি করপোরেশন সুত্রে জানা গেছে, দুটি গভীর নলকূপ প্রদান করেছে সিসিক। পানির ব্যবস্থাও করেছে। লাইট দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে সিটি করপোরেশনের সহযোগিতা রয়েছে সার্বক্ষণিক। এছাড়াও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য পিডিবির পক্ষ থেকে ২টি অস্থায়ী ট্রান্সফরমার স্থাপন করা হয়েছে।
তাবলিগ জামাতের একাধিক সাথি ও কর্মীর সাথে আলাপ করে জানা যায়, জানুয়ারি মাসে টঙ্গীর তুরাগ নদের পাড়ে দুধাপে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ব ইজতেমার আগে সিলেটের ইজতেমা হওয়ায় অন্তত ১০ থেকে ১২ লাখ মুসল্লির সমাগম ঘটবে। তারা আরও বলেন, আল্লাহর নামে কোনো কাজ শুরু করলে তা আটকে থাকে না। এর কারণ হচ্ছে, সিলেটের তাবলিগের মুরব্বিরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সিলেটে তিন দিনের ইজতেমা হবে। এ জন্য কোনো সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক কিংবা কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব কাউকে দেওয়া হয়নি। কোনো টাকার ব্যবস্থা ছাড়াই ইজতেমার মাঠের কাজ শুরু হয়। আল্লাহর নামে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সবাই সহযোগিতা করছেন। কোনো শ্রমিক টাকায় আনা হয়নি। মানুষ নিজ উদ্যোগে শ্রম দিয়ে ইজতেমার মাঠ মুসল্লিদের জন্য করে দিচ্ছেন।
এদিকে ইজতেমার আশপাশে রয়েছে বিপুলসংখ্যক দোকান। বসেছে রেস্টুরেন্টও। স্থানীয়রা বলছেন, ওই এলাকায় এবার ইজতেমা হওয়ায় ব্যবসায়ীদেরও ব্যবসা ভালো হচ্ছে। এছাড়াও সিভিল সার্জনসহ দাতব্য সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে ইজতেমা ময়দানে মেডিকেল ক্যাম্প খোলা হয়েছে। অসুস্থ মুসল্লিদের খেদমতে রয়েছে আল মারকাজুল খায়েরি আল ইসলামির অ্যাম্বুলেন্স। রেডক্রিসেন্টের তরফ স্বাস্থ্য সেবার জন্য একটি ক্যাম্প খোলা হয়েছে।
নিরপত্তা ব্যবস্থা :
সিলেটে আয়োজিত তিনদিনব্যাপী ইজতেমা ঘিরে চার স্থরের নিরাপত্তা বেষ্টনী রয়েছে। তাবলিগ জামায়াতের সর্ববৃহৎ এই আয়োজনের নিরাপত্তার জন্য ইজতেমার ময়দানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চার স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। রয়েছে চেক পোস্ট, পিকেট পার্টি, খিত্তা ভিত্তিক পার্টি, সাদা পোশাকের পুলিশ। এছাড়া র‌্যাব সদস্যরাও স্ট্যান্ডবাই ডিউটি করছেন বলে জানিয়ে সিলেট মহানগর পুলিশ সুত্র। সুত্র আরো জানায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। সেই সঙ্গে পুলিশ সদস্যরা বাইনোকুইলারের মাধ্যমে পুরো এলাকার ওপর নজরদারি করছেন। পুলিশের পক্ষ থেকে মাঠের পুর্ব পাশে একটি ক্যাম্প, কন্ট্রোল রুম ও ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও বিশ্ব ইজতেমার সার্বিক ব্যবস্থাপনায় জেলা প্রশাসককে প্রধান করে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা ছাড়াও কয়েকটি উপ-কমিটিও রয়েছে।
এদিকে, ইজতেমার ২য় দিন শুক্রবার জুমার নামাজকে ঘিরে ইজতেমা ময়দানে নেয়া হয় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রায় চার সহস্রাধিক পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা মুসল্লিদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকেন। সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (মিডিয়া) জেদান আল মুসা সংবাদমাধ্যমকে জানানা, কঠোর নিরাপত্তায় সিলেটে ইজতেমা ময়দানে জুমার নামাজ আদায় করেছেন মুসল্লিগণ। কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
শুক্রবারে ইজতেমায় ৭টি জানাজা :
সিলেট জেলা ইজতেমা মাঠে শুক্রবার ভোরে ১নং মোল্লারগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শেখ মাহমুদ আলীর মৃত্যু হয়েছে। জুমার নামাজের পর ইজতেমা ময়দানে মাহমুদ আলীসহ সাতজনের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মাহমুদ আলী স্থানীয় তেলিরাই জামে মসজিদের মোতাওয়াল্লির দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়াও ইজতেমা ময়দানের আশপাশ এলাকায় শুক্রবার আরো ছয়জনের মৃত্যু হয়। এ সাত জনের মরদেহ ইজতেমা ময়দানে নিয়ে আসা হয়। পরে জুমার নামাজ শেষে একসঙ্গে তাদের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

আরও পড়ুন  আমরাও যেন যুদ্ধজাহাজ তৈরি করতে পারি-প্রধানমন্ত্রী

———————-
১২:০৭ : ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ