নিষ্টুর প্রতারণা এবং নূপুরের নিভু নিভু জীবন প্রদীপ

প্রকাশিত: ২:০০ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ১৭, ২০২০

নিষ্টুর প্রতারণা এবং নূপুরের নিভু নিভু জীবন প্রদীপ

নিষ্টুর প্রতারণা এবং নূপুরের নিভু নিভু জীবন প্রদীপ

ইমরান ইমন, ফেনী♦  রাত দশটার পর শুভ ভাই ফোন দিয়ে বললো- ভাই কি অবস্থা? আমি বললাম- এইতো ভাই চলছে। শুভ ভাই আশাচ্ছন্ন কন্ঠে বলে উঠলো- আচ্ছা ভাই তোমার কি ব্লাড দেওয়ার সময় হয়েছে?
আমি বললাম- জ্বি ভাই দিতে পারবো। আচ্ছা ঠিক আছে ভাই আমি প্যাসেন্টের মা’কে তোমার নাম্বার দিচ্ছি, উনি তোমায় কল করবেন।

 

 

মিনিট দশেক পর একটা নাম্বার থেকে কল আসলো। হতাশা মুখর কন্ঠে শুনতে পেলাম-“বাবা, তুমি কি ইমন? আমাকে শুভ তোমার নাম্বারটা দিয়েছেন।” আমি এতক্ষণে বুঝে গেছি উনি কি উদ্দেশ্যে কল করেছেন।

 

 

 

আমি বললাম- জ্বি আন্টি, আমি ইমন। হ্যাঁ শুভ আমাকে বলেছে। এবার আমরা পরিচিত হলাম। কথা বলতে বলতে জানতে পারলাম- উনি আমাদের এলাকার, মুন্সিরহাটের তারালিয়া গ্রামে ওনাদের বাড়ি। আমাকে উনি বললেন- আমি যেন সকাল ১০ টার আগে সদর হাসপাতালে উপস্থিত থাকি। আমি আস্বস্ত করলাম সকাল ১০ টার আগেই আমি হাসপাতালে উপস্থিত থাকবো।

 

 

 

 

তিন ঘণ্টা ঘুমের অবশ অনুভূতির শরীর নিয়ে ঘুম থেকে ওঠে নাস্তা করা ছাড়াই ছুটে গিয়েছি হাসপাতালে। আমার এই কম ঘুম যাওয়া নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করেন, অনেকেই বলেন- ভাই আপনি এত কম ঘুমিয়ে কীভাবে থাকেন! এভাবে করতে থাকলে তো পরবর্তীতে অনেক সমস্যা হবে। আমার সাদাসিধে উত্তর- ভাই বাঁচব বা কয়দিন। একটু কাজ-টাজ করে যাই। আমরা যদি ৬০ বছর বাঁচি, এরমধ্যে গড় হিসেবে আমরা ৪০ বছরই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেই।

 

 

 

আমি যখন হাসপাতালের রক্তসঞ্চালন বিভাগে গিয়ে উপস্থিত হই তখন ঘড়ির কাঁটা ৯:৩৩ এর ঘরে। ওখানে গিয়ে ওই আন্টিটাকে ফোন দেই। উনি এসে আমার ক্রসম্যাচিং এর ব্যবস্থা করলেন। স্যাম্পল দিয়ে আমি বাইরের একটা চেয়ারে বসে আছি। ওই আন্টিটা গেটের পাশে দাঁড়ানো একজনের ছেলের সাথে কেঁদেকুদে কথা বলছেন। “আমার ৮ লাখ টাকা দালাল খেয়ে নিয়েছে”- এ লাইনটা আমার কানে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমি উড়ে দাঁড়াই। ওনাকে বিস্তারিত ঘটনা জিজ্ঞেস করতে থাকি।

আরও পড়ুন  খোকন এ্যানি নীরবসহ বিএনপির ২৮ নেতাকর্মীর বিচার শুরু

 

 

 

এরই মাঝে ব্লাড দেওয়ার জন্য আমাকে ডাকা হচ্ছে। আমি ব্লাড দিতে গেলাম। আমাকে একটা বেডে শোয়ানো হলো। আমার বয়সী ছিমছাম একটা ছেলে সুই আর ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তার দিকে ঢেবঢেব চোখে তাকিয়ে আছি। আমাকে ও জিজ্ঞেস করলো- “ইমরান ইমন ভাই কী অবস্থা?” আমি বললাম- এইতো ভাই ভালোই। আমি এখনও তার দিকে ঢেবঢেব চোখে তাকিয়ে আছি। এই ছেলেটা আমার নাম জানে, মানে নিশ্চয়ই আমাকে চেনে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করাই আগেই সে বলে উঠলো ভাই আপনাকে আমি চিনি, আপনি একজন বড়ো মাপের কলামিস্ট, আমি আপনার লেখা নিয়মিত পড়ি, অফিসে পত্রিকা আসলেই সবার আগে চেক করি আপনার লেখা আছে কিনা।

 

 

 

আমি অবাক হচ্ছি তার কথায়। আমি তাকে চিনি না, জানি না অথচ সে আমাকে চেনে। একজন প্রকৃত লেখকের সার্থকতা এখানেই। গণমানুষ তাকে চিনবে, জানবে। মানুষের কাছ থেকে প্রশংসা কুড়িয়ে নেওয়া একজন লেখকের বড় প্রাপ্তি। ব্লাড ব্যাংক পরিপূর্ণ হতে হতে আমরা বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা বলছিলাম। ব্লাড নেওয়া শেষ হলে আমি বেড নেমে পড়ি। ছেলেটার সাথে বিদায় নিয়ে বের হয়ে পড়েছি। রুম থেকে বের হতে হতে আন্টিটা বললো- আমার মেয়ে নূপুর নাকি তোমার ক্লাসমেট, সে নাকি তোমাকে চেনে। আমি থ হয়ে গেলাম। আমার ক্লাসমেট!

 

আরও পড়ুন  অপরাজিত থেকেই সেমিতে সিলেট ইউনাইটেড

 

 

আমি সঙ্গে সঙ্গে ডায়ালাইসিস ইউনিটে ওর কাছে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি ডায়ালাইসিস মেশিনের সাথে জীবন নিয়ে ও যুদ্ধ করছে। আমাকে দেখে খুব সুন্দর করে একটা সালাম দিলো। আমি অনেকক্ষন তার পাশে বসে কথা বললাম। জানতে পারলাম সে আমার এসএসসি ২০১৭ ব্যাচের, কমার্স গ্রুপের, আলী আজম স্কুল এন্ড কলেজের। এইচএসসিও আলী আজম স্কুল এন্ড কলেজ থেকে দিয়েছে।

 

 

 

একবছর আগে রিপোর্টে ধরা পড়ে নূপুরের দুটো কিডনিই অকেজো হয়ে গেছে। পরিবারের একমাত্র সন্তান নূপুর। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারটির মাথায় তখন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। সন্তানকে বাঁচাতে পাগলের মত এক হাসপাতাল থেকে অপর হাসপাতালে মা ছুটে বেড়াচ্ছেন। এক পর্যায়ে জায়গাজমিন সব বেছে দিয়েছেন। ডাক্তার সাজেশন দিলো একটা কিডনি লাগালে নূপুর আমার স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে। নূপুরের মা-বাবা এবার সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে কিডনি লাগানোর পেছনে দৌড়ছেন। পড়লেন দালালের খপ্পরে। মেয়ের কিডনি লাগাবে বলে ওনাদের কাছ থেকে ৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে দালালচক্র। আর তা নাকি নিজস্ব কারো মাধ্যমেই হয়েছে। আবার কোথাও থেকে সাহায্য আসলে ওটাতেও নাকি ভাগ বসায় দালালচক্র। টাকা নিয়েছে ঠিকই কিন্তু লাগানো হয়নি কিডনি। আর তার ফলস্বরূপ ডায়ালাইসিস মেশিনের সাথে জীবন নিয়ে যুদ্ধ করছেন নূপুর।

 

 

 

 

 

কী অমানবিক,কী নিষ্টুর সমাজে আমরা বসবাস করছি। আমাদের মানবিকতা, মনুষ্যত্ববোধ আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে! আমি কখনো ভুলেও কল্পনা করিনি, আমাকে এমন একটা নিষ্ঠুরতম ঘটনা নিয়ে লিখতে হবে। আন্টিটা যখন আমাকে ঘটনাগুলো বলছিল তখন আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরছিল। কোথায় আমাদের বসবাস! আমরা মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছি?

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।

সর্বশেষ সংবাদ