শেখ হাসিনা বাংলার ফিনিক্স পাখি (পর্ব-২)

প্রকাশিত: ৫:২১ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২, ২০২৩

শেখ হাসিনা বাংলার ফিনিক্স পাখি (পর্ব-২)

[ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী রাষ্ট্রনায়কদের অন্যতম। একই সাথে দেশে- বিদেশে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন সংগ্রামী এই নেত্রী। শেখ হাসিনার জীবন, কর্ম, বেড়ে উঠা, ঘাত -প্রতিঘাত নিয়ে অনেকটা স্মৃতিচারণমূলক সংকলিত প্রবন্ধ  প্রভাতবেলা’য় মেইল করেছেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ ও প্রকাশনা বিভাগের উপ-পরিচালক খলিলুর রহমান ফয়সাল। সময়, প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা বিবেচনায় পাঠকদের জ্ঞাতার্থে প্রবন্ধটি প্রভাতবেলা’য় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে- সম্পাদক ]

বিবিসি হিন্দি’র রেহান ফজলের প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি, যুগো¯øাভিয়ার রাষ্ট্রপতি মার্শাল টিটো শেখ মুজিবের দুই কন্যা ও জামাতার খোঁজখবর নেওয়ার জন্য ফোন করেছিলেন। কিন্তু এরপরে তাঁরা কোথায় থাকবেন, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছিল না। হুমায়ূন রশিদ চৌধুরীর পুত্র নোমান রশিদ চৌধুরী ২০১৪ সালের ১৫ই অগাস্ট একটি জাতীয় পত্রিকায় ‘বঙ্গবন্ধু’জ ডটার্স’ (বঙ্গবন্ধুর কন্যারা) শিরোনামের একটি লেখায় স্মৃতিচারণ করেছেন এই ভাবে, “পশ্চিম জার্মানিতে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত ওয়াই কে পুরীর সঙ্গে আমার বাবার দেখা হয়েছিল একটা ক‚টনৈতিক অনুষ্ঠানে।

 

তিনি মি. পুরীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে ভারত কি শেখ হাসিনা আর তাঁর পরিবারকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে পারবে কি না? তিনি খোঁজ নিয়ে জানাবেন বলেছিলেন। পরের দিন মি. পুরী আমার বাবার সঙ্গে দেখা করতে তাঁর দপ্তরেই চলে আসেন। তিনি জানিয়েছিলেন যে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়াটি অনেক জটিল ও সময়সাধ্য। তিনিই বলেন, দিল্লিতে তো বাবার নিজেরই অনেক চেনাশোনা, কারণ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে সেখানে মিশন প্রধান ছিলেন তিনি। ইন্দিরা গান্ধী আর তাঁর দুই পরামর্শদাতা ডি পি ধর এবং পি এন হাক্সর তো বাবাকে বেশ পছন্দ করেন। তাঁদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন মি. পুরী। তাঁর সামনেই মি. চৌধুরী ডি পি ধর এবং পি এস হাক্সরকে ফোন করেন। কিন্তু দুজনেই সেসময় ভারতের বাইরে। সরাসরি ইন্দিরা গান্ধীকে ফোন করতে মি. চৌধুরী একটু ইতস্তত করছিলেন।

 

মিসেস গান্ধী একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী আর মি. চৌধুরী একজন সাধারণ রাষ্ট্রদ‚ত। মিসেস গান্ধীর সঙ্গে তাঁর কয়েকবার সাক্ষাত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বছর তিনেক তাদের মধ্যে কোনও যোগাযোগ ছিলনা। রাজনীতিতে তিন বছর অনেকটা লম্বা সময়। আর তারও পরে তখন ভারতে জরুরী অবস্থা চলছে। মিসেস গান্ধী নিজেই ব্যতিব্যস্ত।” নোমান রশিদ চৌধুরী লিখেছেন, “যখন কোনও দিক থেকেই কিছু হচ্ছিল না, তখন একরকম শেষ চেষ্টা করে দেখার জন্য বাবা মিসেস গান্ধীর দপ্তরে একদিন ফোন করেই ফেললেন।

আরও পড়ুন  ইরাকে বিয়েতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, নিহত ৪৫০

 

ঘটনাচক্রে সেই ফোনটা ইন্দিরা গান্ধী নিজেই তুলে ছিলেন। বাবা মিসেস গান্ধীকে গোটা বিষয়টা খুলে বললেন। তক্ষুনি বঙ্গবন্ধুর কন্যাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে রাজী হয়ে গিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী।”

 

জার্মানিতে ভারতের রাষ্ট্রদূত মি. পুরী ১৯ আগস্ট হুমায়ূন রশিদ চৌধুরীকে জানিয়েছিলেন যে দিল্লি থেকে নির্দেশ এসেছে শেখ মুজিবের দুই কন্যা এবং তাঁদের পরিবারকে খুব দ্রæত সেখানে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে । এদিকে ব্যাথা-বেদনায়, সন্দেহ-অনিশ্চয়তায় জর্জরিত শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। হুমায়‚ন রশিদ চৌধুরীকে ঘরের বাইরে নিয়ে ওয়াজেদ মিয়া ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান।

 

নিরাপদ স্থানে না পৌঁছানো পর্যন্ত শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানাকে কোনো কিছু জানানো হবে না, এ শর্তে হুমায়‚ন রশিদ চৌধুরী ওয়াজেদ মিয়াকে বলেন, ‘বিবিসির এক ভাষ্যানুসারে রাসেল ও বেগম মুজিব ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই এবং ঢাকাস্থ ব্রিটিশ মিশন কর্তৃক প্রচারিত এক বিবরণীতে বলা হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউ বেঁচে নেই।’ ২৩ আগস্ট সকালে ভারতীয় দূতাবাসের এক কর্মকর্তা ওয়াজেদ মিয়াকে টেলিফোন করে জানান, ভারতীয় দ‚তাবাসের একজন ফার্স্ট সেক্রেটারি তাদের সঙ্গে দেখা করবেন।

 

সেদিন দুপুর ২টার দিকে ওই কর্মকর্তা ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে দেখা করে বলেন, পরের দিন অর্থাৎ ২৪ আগস্ট সকাল ৯টায় তাদের ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারতীয় দূতাবাসের ওই কর্মকর্তা ২৪ আগস্ট তাদেও ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে নিয়ে যান। তবে তাদের গন্তব্যের বিষয়টি সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়।

 

এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমানে ২৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ৮টার দিকে দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে পৌঁছান শেখ রেহানা, শেখ হাসিনা, ওয়াজেদ মিয়া এবং তাদের দুই সন্তান জয় ও পুতুল। ভারতীয় মন্ত্রিপরিষদের একজন যুগ্ম সচিব তাঁদের স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে হাজির ছিলেন। প্রথমে ৫৬ নম্বর রিং রোডের একটি ‘সেফ হাউস’-এ তাঁদের রাখা হয়েছিলো। পরে ডিফেন্স কলোনির একটি বাড়িতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের। দশ দিন পর, ৪ঠা সেপ্টেম্বর, ভারতের বৈদেশিক গুপ্তচর সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং বা ‘র’-এর একজন কর্মকর্তা তাঁদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আবাস ১ নম্বর সফদরজং রোডে পৌঁছান।

শেখ হাসিনা বাংলার ফিনিক্স পাখি

শেখ হাসিনা বাংলার ফিনিক্স পাখি- ফাইল ছবি সংগৃহিত

দেখা হওয়ার পরে ইন্দিরা গান্ধীকে শেখ হাসিনা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “১৫ই অগাস্ট ঠিক কী হয়েছিল?” সেখানে উপস্থিত একজন অফিসার শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন, তাঁর পরিবারের আর কেউ জীবিত নেই। এটা শুনেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার জীবনীকার সিরাজউদ্দিন আহমেদ লিখেছেন, “ইন্দিরা গান্ধী হাসিনাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত¡না দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তোমার যা ক্ষতি হয়েছে, তা তো পূরণ করা যাবে না। তোমার তো এক ছেলে, এক মেয়ে আছে। আজ থেকে ছেলেকে নিজের বাবা আর মেয়েকে নিজের মা বলে মনে করো।”

আরও পড়ুন  সেমিফাইনালে বাংলাদেশ

 

ভারতীয় সরকারের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে ইন্ডিয়া গেটের কাছে পান্ডারা পার্কের সি বøকে একটি ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছিলো। ওই ফ্ল্যাটে তিনটি বেডরুম আর কয়েকটি আসবাবপত্র ছিল। পরে তিনি নিজেই কিছু কিছু আসবাব কিনেছিলেন। তাঁর ওপর কড়া নির্দেশ ছিল যে, তিনি যেন ঘরের বাইরে না যান, অথবা কারও সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ না করেন। তাদের ঘরে একটা টেলিভিশন সেট দেওয়া হয়েছিলো।

 

তৎকালীন সময়ে ভারতের টেলিভিশনে শুধুমাত্র দু’ঘণ্টার জন্য দ‚রদর্শনের অনুষ্ঠান প্রচারিত হত। তবে তাদের বাড়িতে কোনো টেলিফোন সংযোগ দেওয়া হয়নি। ‘র’-এর একজন প্রাক্তন অফিসার নাম না প্রকাশের শর্তে বলছিলেন, “শেখ হাসিনার নিরাপত্তার জন্য দু’জনকে রাখা হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন সত্য ঘোষ নামের এক ইন্সপেক্টর। পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাঁকে নিয়ে আসা হয়।

অন্যজন ছিলেন ১৯৫০ সালের ব্যাচের ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিস অফিসার পি কে সেন। ঘটনাচক্রে ইন্সপেক্টর সেনকে ‘কর্নেল’ হিসাবে, আর পদাধিকার বলে তাঁর থেকে অনেক উঁচুতে, আইজি র্যাঙ্কের অফিসার পি কে সেনকে ‘ইন্সপেক্টর’ হিসাবে শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্বে রাখা হয়েছিল। এই দু’জন অফিসারই ছায়ার মতো শেখ হাসিনা পরিবারের সঙ্গে থাকতেন।

শেখ হাসিনার স্বামী ডক্টর ওয়াজেদ মিয়াকে ১৯৭৫ সালের ১লা অক্টোবর ভারতের পরমাণু শক্তি বিভাগে ফেলোশিপ দেওয়া হয়েছিলো। ‘র’-এর ওই প্রাক্তন কর্মকর্তা বলছিলেন, “শেখ হাসিনার সব খরচ ভারত সরকারই দিত। যদিও সেটা খুব সামান্যই ছিল। টাকাটা কলকাতায় তাঁর এক পরিচিত চিত্তরঞ্জন সুতারের মাধ্যমে দেওয়া হত।” শেখ হাসিনা যে দিল্লি আছেন, সেই খবরটা ভারতীয় সরকার গোপন রাখতেই চেয়েছে।

 

তবে বাংলাদেশের তৎকালীন সরকার তাঁর অবস্থান জেনে গিয়েছিলো। ১৯৭৬ সালের মে মাসের গোড়ার দিকে বাংলাদেশের উপ-রাষ্ট্রদ‚ত শামসুর রহমান আর তাঁর স্ত্রী দেখা করতে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানার সঙ্গে। দুই বোন তাঁদের দেখে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করেছিলেন।

খলিলুর রহমান ফয়সাল, উপ-পরিচালক, জনসংযোগ ও প্রকাশনা বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।

সর্বশেষ সংবাদ