সিলেট ২০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ |
প্রকাশিত: ৮:৫৮ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২৯, ২০২০
পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতা মানেই নারীকে অধস্তন করে রাখার ইতিহাস। সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্র, পরিবারে পুরুষের একাধিপত্য জারি রাখার এ এক লৈঙ্গিক রাজনীতি। রীতিটি টিকিয়ে রাখার জন্য যখন যেমন প্রয়োজন সে রকম আইন, কানুন, নীতি, নৈতিকতা, প্রথা তৈরি করেছে পুরুষ; চাপিয়ে দিয়েছে নারীর ওপর। এর বেশির ভাগই শুধু অমানবিক নয়, গা শিউরানো নৃশংসতার ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্ত। ধর্ম ও বর্ণভিত্তিক ভারতীয় সমাজে এমনই দুই বর্বরতম প্রথা সতীদাহ ও বিধবাদের পুনর্বিবাহে নিষেধ।
উনিশ শতকে ইউরোপীয় শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে উপনিবেশিত বাংলায় সামাজিক নবজাগরণ ঘটে। এর কেন্দ্রীয় দুই ব্যক্তি রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১)। এই দুই সংস্কারকের প্রচেষ্টায় ভারতীয় হিন্দু নারীদের উপর চেপে বসা নৃশংসতম সতীদাহ প্রথা বিলোপ ও বিধবা বিবাহ চালু হয়। সমাজের রক্ষণশীল অংশের প্রবল বিরোধিতা ও আক্রমণের মুখে পড়েন তারা উভয়েই। ধর্মান্ধ শাস্ত্রকানা সমাজে বেদ, উপনিষদ, সংহিতা, পুরাণ ঘেঁটেই রামমোহন ও বিদ্যাসাগর তাদের যুক্তি সাজিয়েছিলেন। তাদের যুক্তির কাছে প্রথাগত শাস্ত্রকার ও সমাজপতিরা পরাজিত হয়ে বেছে নিয়েছিলেন ষড়যন্ত্রের পথ। রেনেসাঁসের ফলে ইউরোপে যে মানবতাবাদের বিকাশ ঘটেছিল, তার ফলেই ইংরেজ শাসকেরা এগিয়ে এসেছিলেন ভারতীয় সমাজের সংস্কারে। আইন পাস করেছিলেন নারীর প্রতি নৃশংস দুই প্রথা বন্ধের।
সতীদাহ প্রথা বাতিলের আইন পাস হয় ১৮২৯ সালে। হিন্দু বিধবা পুনর্বিবাহ আইন ১৮৫৬ সালে। ভারতীয় হিন্দু নারীদের অধিকারের প্রশ্নে মাইলফলক আইন দুটি প্রবর্তনের পর দেড় শ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। সংস্কারবাদী হলেও রামমোহন-বিদ্যাসাগরের হাতে আমাদের সমাজে নারীর অধিকারের যে দুয়ার খুলেছিল, তা কতটা পথ পেরোতে পেরেছে? আজ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ও অবদান আশাজাগানিয়া হলেও ধর্ষণ, কন্যা-ভ্রূণ হত্যা, বাস্তব ও সাইবার জগতে নারী লাঞ্ছনা, নির্যাতন ও সহিংসতার যে মহামারি চলছে, তাতে করে প্রশ্ন জাগেই, পুরুষতন্ত্রের জোয়াল কতটা ভাঙতে পেরেছে আমাদের সমাজ?
হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী সতী শিবের স্ত্রী। বাবা প্রজাপতির মুখে স্বামীর নিন্দা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন তিনি। প্রথাগত সমাজে স্বামীর প্রতি আনুগত্য ও পতিব্রতার প্রতীক সতী। সমাজ ও ধর্মের অধিপতিরা সতীর এই পৌরাণিক মাহাত্ম্যকে ব্যবহার করেছেন নারী হত্যার মতাদর্শিক ক্ষেত্র তৈরিতে। শত শত বছর ধরে ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজে নারীর নিজস্ব কোনো অধিকার আর সত্তার স্বীকৃতি ছিল না। জন্ম নিয়ে নারী পিতার অধীন, বড় হলে স্বামী আর বয়স্ক হলে সন্তানের অধীন। সম্পত্তিতে নারীর কোনো অধিকার স্বীকার করা হতো না। গৌরিদান ও কুলীনপ্রথার মতো সামাজিক অনাচার জেঁকে বসেছিল সমাজে। গৌরিদান মানে মেয়ের বয়স আট না পেরোতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য করা। কুলীনপ্রথার মাধ্যমে কুল বা বংশ রক্ষার জন্য ঘাটের মড়ার সঙ্গে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হতো। একেকজন কুলীনের জীবিকা ছিল একের পর এক বিয়ে করা। ধর্মরক্ষার নামেই এ ধরনের অমানবিক, পিতৃতান্ত্রিক প্রথাগুলোর প্রচলন ছিল।
ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাতেই সতীদাহ প্রথার প্রচলন। তেইশ শ বছর আগে গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের বিবরণে সতীদাহ প্রথার সন্ধান মেলে। মোগল সম্রাট শাহজাহান এ প্রথার রাশ টেনে ধরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ইংরেজ শাসকেরাও তাদের শাসন, শোষণ বজায় রাখতে গিয়ে নিষ্ঠুর এ প্রথার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারছিলেন না। উনিশ শতকের প্রথম দিকে বাংলায় সতীদাহের সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। ১৮১৫-১৮২০ সালের মধ্যে বাংলায় ৩ হাজার ৬১৩টি সতীদাহের ঘটনা ঘটে। হিন্দু ধনীরা রীতিমতো পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন। ফলে শুধু সহমরণ নয়, অনুমরণ, সহসমাধিসহ নানা প্রথার বাড়বাড়ন্ত ছিল এ সময়।
রামমোহনের এই লেখা সমাজে প্রবল আলোড়ন তুলল। খ্রিস্টান মিশনারি, ব্রাহ্মসমাজ ও হিন্দু যুক্তিবাদী মানুষেরা দাঁড়ালেন তার পাশে। কিন্তু রক্ষণশীল সমাজ কোমর বেঁধে লাগল তার বিরোধিতায়। পাল্টা পুস্তিকা লিখে রামমোহনকে আক্রমণ করল তারা। শাস্ত্র ঘেঁটে রামমোহন পাল্টা যুক্তি দিয়ে দেখিয়ে দিলেন শাস্ত্রকারদের অসারতা। ওয়ারেন হেস্টিংস ও আমর্হাস্টের শাসনকালে দেশীয় এ প্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার সাহস পাননি তারা। উইলিয়াম বেন্টিংক আসার পরে ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর কাউন্সিলে সতীদাহকে ‘অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ’ হিসেবে আইন পাস করে। এই আইনের বিরুদ্ধে রক্ষণশীল হিন্দুরা ‘ধর্মসভা’ গঠন করে রাজপথে নামে, ব্রিটেনের প্রিভি কাউন্সিলে আপিল করে। রামমোহন আইনগতভাবে লড়তে ইংল্যান্ডে যান। ১৮৩২ সালের ১২ জুলাই প্রিভি কাউন্সিলে সতীদাহ সমর্থকদের আপিল খারিজ হয়ে যায়। ফলে বন্ধ হয়ে যায় নিষ্ঠুর, অমানবিক নারীহত্যার এই প্রথা।
সতীদাহ প্রথা বন্ধের ২৭ বছর পর ১৮৫৬ সালে হিন্দু নারীদের অধিকারের প্রশ্নে আরেক যুগান্তকারী সংস্কারের পথ খোলে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় ওই বছরের ২৬ জুলাই হিন্দু বিধবা পুনর্বিবাহ আইন পাস হয়। রামমোহনের মতো বিদ্যাসাগরও জানতেন, ধর্মীয় ও শাস্ত্রীয় গোঁড়ামি ভাঙতে হলে শাস্ত্রের আশ্রয়ই নিতে হবে। পরাশর সংহিতায় তিনি পেয়েছিলেন দুই লাইনের একটা শ্লোক। ‘নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে. ক্লীবে চ পতিতে পতৌ’- অর্থাৎ স্বামী নিখোঁজ হলে বা তার মৃত্যু হলে, নপুংসক আর পতিত হলে তার স্ত্রী আবার বিয়ে করতে পারেন। এর উপর ভিত্তি করেই ১৮৫৫ সালের জানুয়ারিতে বিধবা বিবাহের পক্ষে মানবতাবাদী বিদ্যাসাগর লিখলেন পুস্তিকা। প্রবল আলোড়ন উঠল সমাজে। সে সময়ে তার বই তিনটি সংস্করণে ১৫ হাজার কপি নিঃশেষ হয়ে যায়। ব্রাহ্মসমাজসহ যুক্তিবাদী অংশ দাঁড়ালেন বিদ্যাসাগরের পক্ষে। কিন্তু সংখ্যায় তারা নগণ্য। বিধবা বিবাহ চালুর পক্ষে বিদ্যাসাগর সরকারের কাছে যে আবেদনপত্র জমা দিয়েছিলেন, তাতে স্বাক্ষর করেছিলেন ৯৮৬ জন। অন্যদিকে রক্ষণশীল সমাজের নেতা রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে পাল্টা আবেদনপত্র জমা হয়েছিল, তাতে স্বাক্ষর ছিল ৩৬ হাজার ৭৬৩ জনের। রক্ষণশীল অংশের পন্ডিতদের সঙ্গে প্রকাশ্যে বাহাস করেন বিদ্যাসাগর। তাতে পরাজিত হয়ে রক্ষণশীল সমাজ বিদ্যাসাগরকে মারার জন্য গুন্ডা নিয়োগ করে। পত্রপত্রিকায় তার নামে ব্যঙ্গবিদ্রূপ ও কুৎসার ঝড় ওঠে।
নারীরা সমাজের অর্ধেক অংশ। ব্যক্তি হিসেবে নারীর নিজস্ব সত্তা; সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবারে তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে। কিন্তু আমাদের রক্ষণশীল ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে নারীর পূর্ণ স্বীকৃতি এখনো দিতে নারাজ। এই রক্ষণশীল বাস্তবতার উপর দাঁড়িয়ে আমাদের সমাজ যত পুঁজিতান্ত্রিক ও পণ্যকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে, নারীকে ভোগ্য হিসেবে দেখার প্রবণতা ততই বাড়ছে। ফলে ধর্ষণ, নারী নিপীড়ন সমাজে বিষবৃক্ষের মতো চেপে বসেছে। রামমোহন, বিদ্যাসাগর কিংবা রোকেয়ারা সমাজের গভীরতর ক্ষতগুলো দেখিয়ে দিয়ে নারীর অধিকারের পথ তৈরি করে দিয়েছিলেন। নিজেদের জীবনকেই উৎসর্গ করেছিলেন এ কাজে। তাদের জীবন ও কর্ম থেকে আমরা কতটা শিখতে পারছি, তার উপরেই নির্ভর করছে আমাদের সমাজে নারীর মুক্তি কোন পথে এগোবে।
লেখক: মনোজ দে
সম্পাদক : কবীর আহমদ সোহেল
নির্বাহী সম্পাদক: মোঃ আব্দুল হক
ঢাকা অফিস : ২৩৪/৪ উত্তর গোড়ান, খিলগাঁও, ঢাকা ।
সম্পাদক কর্তৃক প্রগতি প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং লিঃ, ১৪৯ আরামবাগ, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।
সিলেট অফিস: ২৩০ সুরমা টাওয়ার (৩য় তলা)
ভিআইপি রোড, তালতলা, সিলেট।
মোবাইল-০১৭১২-৫৯৩৬৫৩, ০১৭১২-০৩৩৭১৫
E-mail: provatbela@gmail.com,
কপিরাইট : দৈনিক প্রভাতবেলা.কম
আমাদের সর্ম্পকে গোপনীয়তা যোগাযোগ
Design and developed by ওয়েব হোম বিডি