সুন্দরবন: সৌন্দর্য পিপাসু ভ্রমণকারীদের তীর্থস্থান

প্রকাশিত: ১২:১৭ অপরাহ্ণ, মার্চ ১২, ২০১৮

সুন্দরবন: সৌন্দর্য পিপাসু ভ্রমণকারীদের তীর্থস্থান

হাসানুজ্জামিল মেহেদী : প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি, বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল সুন্দরবন ক্রমেই সৌন্দর্য পিপাসু ভ্রমণকারীদের জন্য হয়ে উঠেছে তীর্থস্থান।তাই আপনি কেন বাদ থাকবেন সুন্দরবন ভ্রমণের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা থেকে। ঘুরে আসুন সুন্দরবন, চারপাশে বানরের খেলা, কুমিরের চলাচল এবং হরিণের মায়াবি চোখ, কাঠের ট্রেইলে বনে হাঁটা আপনাকে দিবে এমন রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, যার স্মৃতি বয়ে বেড়ানো যায় সারা জীবন।

কটকা, টাইগার টিলা ও হিরণ পয়েন্টে যা দেখবেন :

টিভির পর্দায় এনিমেল প্ল্যানেট চ্যানেলে আফ্রিকান বিভিন্ন বনে হরেক রকমের প্রাণির হুড়োহুড়ি, বাঘে হরিণে এক ঘাটে জল খাওয়ার দৃশ্য, গাছে গাছে বানরের ঝোলাঝুলি দেখে কত দিন কেটেছে আমাদের। মনে মনে কখনো হয়তো ভেবে বসেছেন, এসব সাফারি পার্কে গিয়ে ঘুরে আসলে কেমন হয়। তা যাওয়া হোক না হোক, আপনার সেই আশা একটু হলেও মেটাতে পারে সুন্দরবন। করমজল ও হাড়বাড়িয়ায় যা দেখবেন আপনারা, কটকা, টাইগার টিলা ও হিরণ পয়েন্ট দেখাবে তার চেয়েও রোমাঞ্চকর আকর্ষণীয় কিছু।

কটকা জায়গাটি শরণখোলা রেঞ্জে অবস্থিত। এখানকার আসল রূপ ও প্রাণিকূলের খেলা দেখতে পৌঁছুতে হবে যত সম্ভব ভোর বেলায়। ঘাটে পৌঁছানের আ্গেই দূর থেকে দেখতে পাবেন হরিণ দলবেঁধে নদীর পাড় দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বানর দৌড়াচ্ছে, বন্য শূকর কি যে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কটকাতে ঘাটে নামার পর থেকেই চেষ্টা করবেন যত দূর নীরব থাকা যায়, কোলাহল শুনলেই হরিণ দৌড়ে বনে ঢুকে যাবে। এখানে চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে এদের কাণ্ড দেখতে পারেন।

ঘাটে নেমে একটু এগুতেই পাবেন বন বিভাগের অফিস এবং রেস্ট হাউজ, রাস্তার পাশেই পুরো এলাকার একটা মানচিত্র। মানচিত্র দেখে গাইডের সাথে সামনে এগুতে থাকলে পেয়ে যাবেন সমুদ্র সৈকতের মতো বিশাল এলাকা, পানির ছোট ছোট ঢেউ আছড়ে পড়ছে পাড়ে। যত এগুতে থাকবেন, দেখবেন একদিকে ছোট গাছের ঝোপঝাড়, অন্যদিকে ছোটবড় অনেক গাছ উপড়ে পড়ে আছে, কাঠগুলো নরম হয়ে গেছে, কিছু গাছ শুধু দাঁড়িয়ে আছে, পাতা নেই, কাণ্ড নেই, জীবন নেই। শূন্য শূন্য লাগবে আপনার, দেখেই বুঝতে পারবেন এসব সিডরেরই স্মৃতিচিহ্ন। এদিকে যে কাঠের ট্রেইলটা ছিল, সেটাও ভেঙেচুরে গেছে, না হাঁটাই ভালো। এখানে চারদিকে দেখতে পাবেন শুধু হরিণ আর হরিণ, তারা দলবেঁধে ঘাস, লতাপাতা খাচ্ছে, ইচ্ছে হলেই জোরে দিচ্ছে দৌঁড়।

হরিণের খেলা দেখতে দেখতে হালকা বনের ভেতর দিয়েই হাঁটার রাস্তা ধরে এগুতে থাকুন। কিছুক্ষণ হাঁটলেই পেয়ে যাবেন ‘টাইগার টিলা’। এই জায়গাটি আশপাশের অন্যান্য জায়গা থেকে একটু বেশি উঁচু এবং সুন্দরী গাছের ঘন জঙ্গলের মাঝে অবস্থিত। অধিক জোয়ারে কিংবা বন্যাতেও সহজে পানি উঠে না এখানে। ফলে পরিস্থিতি বুঝে বাঘ আশ্রয় নিতে পারে। বাঘ বন থেকে হরিণ শিকার করে এনে এখানে বসে খায়, পর্যটকরাও মাঝেমধ্যেই এখানে হাঁড় মাংস খুঁজে পায়। এমন একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালে কি রোমাঞ্চ অনুভূত হয়, এখানে না গেলে টের পাওয়া যাবে না। বাঘের দেখা পেতে বনের আরো গহীনে চলে যান না যেন, দলছুট তো হওয়াই যাবে না, তাহলে আবার বাঘ মামার সাথে থেকে যেতে হবে। তাই যে পথ দিয়ে এসেছেন, সে পথ দিয়েই আবার ঘাটে ফিরে আসুন। রওনা দিতে হবে হিরণ পয়েন্টের দিকে।

আরও পড়ুন  নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য’র বাংলাদেশ

হিরণ পয়েন্ট কটকা থেকে মোটামুটি বেশ দূরেই অবস্থিত। পশুর থেকে ট্রলারে ঢুকতে হবে অপ্রশস্ত আরেকটি চ্যানেলে। এই নৌপথের মাঝে পাবেন বেশ কয়েকটি ঘাট। পাবেন চর, চরের মধ্যে সুন্দর ঘাস। এই পথেই পাবেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটি ঘাঁটি। এগুলো পেছনে ফেলে দুই পাশের গোলপাতা, গরান, সুন্দরীসহ হরেক প্রজাতির গাছে ঘেরা নদীর পাড়ের গহীন বনের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে, গাছে গাছে নাম না জানা শত পাখির উড়াউড়ি কলকাকলিতে মগ্ন হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাবেন হিরণ পয়েন্টের কাঠের ট্রেইলে উঠার ঘাটে।

হিরণ পয়েন্ট আপনাকে স্বাগতম জানাবে, কাঠের গেটে লেখা দেখবেন ‘নীলকমলে স্বাগতম’। নীলকমল হিরণ পয়েন্টের আরেক নাম। নামের মতোই সুন্দর জায়গাটি, কাঠের ট্রেইলটিও প্রায় নতুন। সুতরাং হাঁটতে কোন বেগ পেতে কিংবা সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে না আপনার।

এখানকার লুকায়িত সৌন্দর্য আবিষ্কার করতে বেশি সময় লাগবে না আপনার, হাঁটতে হাঁটতে প্রায়ই চোখে পড়বে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা লজ্জাবতী কোনো হরিণের। তাদের মোটেও বিরক্ত না করে বনের সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে হাঁটতে থাকুন। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হলেও সমস্যা নেই, ট্রেইলের মাঝপথে পাবেন চমৎকার একটি শেড, বসার জায়গা। সেখানে বসে কিছুক্ষণ আরাম আয়েশ, খোশগল্প করে নিতে পারেন। হাঁটার সময় ট্রেইলের শেষের অর্ধের দিকে দুপাশে পাবেন বেশ খোলামেলা জায়গা, এখানে কেবল বড় বড় সুন্দরী গাছ, মাটি থেকে উপরের দিকে চোখা হয়ে জেগে আছে অজস্র শ্বাসমূল। এই শ্বাসমূলের সৌন্দর্যও যে কতটুকু হতে পারে তা দেখলেই বুঝতে পারবেন। এর মাঝেও হয়তো দৌড়ে বেড়াচ্ছে বানরের দল। নিচের স্যাতস্যাতে পানি কিংবা কাদাতে যে কত প্রকারের ছোট প্রাণী, রঙিন কাকঁড়া তার ইয়ত্তা নেই। ট্রেইলটির প্রায় শেষের দিকে আছে উঁচু একটি ওয়াচ টাওয়ার, এখান থেকে তাকালেও বনের বেশ খানিকটা এক নজরে দেখে নয়নজোড়া জুড়িয়ে নেওয়া যায়। এই ট্রেইলের শেষটা গিয়ে থেমেছে একটি জলাশয়ের ধারে। জলাশয়টি ওখান থেকে বনের ভেতরের দিকে চলে গেছে। এই জায়গাটি এত সুন্দর যে, আপনার ওখানেই থেকে যেতে ইচ্ছে করবে। জোয়ার ভাঁটায় ক্লান্ত খালের কালো জল, তার চারদিকে ঘন সবুজ জঙ্গল। এই জল জঙ্গলের মিলনস্থলকে মনে হবে যেন বেহেশতের টুকরা। ট্রেইলে বসেই কিছুক্ষণ একাগ্রচিত্তে উপভোগ করতে পারেন সেখানকার সৌন্দর্য। আপনার চোখে ধারণ করা সৌন্দর্যের মাঝে আপনি শান্তি খুঁজে পাবেন ফিরে আসার পরও। ফিরতে তো হবেই, আবার সেই একই পথ, একই নদী, কিন্তু দেখার যেন শেষ নেই। ঘুরাঘুরি শেষ হলে জাহাজে ফিরে চা খেতে খেতে ক্লান্তি দূর করে প্রস্তুত হোন পরদিনের জন্য। সুন্দরবন আর পশুরের উপর দিয়ে বয়ে আসা মৃদু হাওয়া লাগবে আপনার গায়ে, আপনি সহযাত্রীদের সাথে গল্প করতে দেখতে থাকবেন বনের সৌন্দর্য,  নদীর সৌন্দর্য, জাহাজ চলতে থাকবে দুবলার চর অভিমুখে।

আরও পড়ুন  পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মডেল হতে পারে

শুরুতেই জানা প্রয়োজন :

সুন্দরবন ভ্রমণ দেশের অন্যান্য স্থানগুলোয় ভ্রমণের চেয়ে একটু আলাদা। কারণ বনাঞ্চল হওয়ায় মেনে চলতে হয় বেশ কিছু নিয়মকানুন, যেমন বন বিভাগের অনুমতি নেওয়া, গার্ড নেওয়া ইত্যাদি। ফলে নিজের ব্যবস্থাপনায় গেলে ভ্রমণের আনন্দের চেয়ে বিড়ম্বনাই বেশি হতে পারে। ঝামেলামুক্ত, সহজভাবে এবং স্বল্প খরচে সুন্দরবন ভ্রমণে ট্র্যাভেল এজেন্সির সহায়তা নেবোয়াই ভালো। ট্র্যাভেল এজেন্সিগুলো প্রতি শুক্র, শনি এবং রবিবার খুলনা থেকে একা কিংবা দলগত, একদিনের কিংবা তিনদিনের প্যাকেজ অফার করে থাকে। আপনি সেখানে গিয়ে কিংবা আগেই যোগাযোগ করে বুকিং দিতে পারেন। আপনার সুন্দরভাবে এবং নিরাপদে ঘুরে আসার সব দ্বায়িত্ব তারাই নেবে। একদিনের প্যাকেজ সাধারণ ভ্রমণ করার সুন্দর নৌযানের মাধ্যমে ‘মংলা-করমজল-হাড়বাড়িয়া- মংলা’ ভ্রমণের ব্যবস্থা আছে। তিনদিনের ভ্রমণে ব্যবহার হয় বিভিন্ন ধরনের ছোটবড় সুন্দর জাহাজ। থাকা-খাওয়ার সব ব্যবস্থা জাহাজেই থাকে। তিনদিনের প্যাকেজে রোড দুটি, একটি হচ্ছে ‘মংলা-করমজল-হাড়বাড়িয়া-কটকা-হিরণপয়েন্ট-দুবলার চর-মংলা’, অপরটি ‘মংলা-করমজল-হাড়বাড়িয়া-কচিখালি-ডিমের চর-মংলা’। একদিনের প্যাকেজ জনপ্রতি ১৫০০-২০০০ টাকা, তিনদিনের প্যাকেজ জনপ্রতি ৮০০০-১০০০০ টাকা পর্যন্ত হয়। এই খরচটা নির্দিষ্ট, কারণ প্রচুর টাকা নিয়ে গেলেও বাড়তি খরচের উপায় নেই।

যেভাবে যাবেন :

ঢাকার বিভিন্ন বাস স্টেশন থেকে সরাসরি মংলা যায় পর্যটন সার্ভিসের অনেক বাস, নামতে পারেন খুলনায়ও, পরে খুলনা থেকে মংলা। বাসভাড়া ৪০০ থেকে সাড়ে ৫০০ টাকার মধ্যেই। পৌঁছানোর পর আপনার প্যাকেজ অনুযায়ী যাবতীয় ব্যবস্থা ট্যুর এজেন্সিই করবে।

কোথায় থাকবেন :

জাহাজে তিনদিনের ভ্রমণে গেলে থাকা খাওয়ার সব সুব্যবস্থা জাহাজেই থাকে। একদিনের ভ্রমণে গেলে, সারাদিন বেড়িয়ে এসে রাতে থাকতে পারেন বন্দর শহর মংলায়। এখানে আছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মোটেল পশুর (০৪৬৬২-৭৫১০০)।

সতর্কতা :

নৌকায় ভ্রমণের আগেই নিশ্চিত হয়ে নিন পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট ও লাইফ বয়া আছে কি না। বনরক্ষী ছাড়া জঙ্গলের ভেতরে ঢুকবেন না, দলছুট হবেন না। ফুড পয়জনিং থেকে বাঁচতে নিরাপদ পানি পান করুন।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।

সর্বশেষ সংবাদ