ওসমানী শিশু উদ্যান : অবাঞ্চিতদের অবাধ অবস্থান

প্রকাশিত: ১:১০ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৮, ২০১৬

প্রভাতবেলা প্রতিবেদক: ওসমানী শিশু উদ্যান। নামেই পরিচয়। সিলেট নগরীর শিশু বিনোদনের ‘সবেধন নীলমনি’। ইট কংক্রিটের নগর জীবনে শিশু সন্তানকে একটু হাফ ছাড়ার সুযোগ। ছোট খাট গুটি কতেক ইভেন্ট দিয়ে সাাঁজানো এই শিশু বিনোদন কেন্দ্র। হাজারো অসঙ্গতি আর সীমাবদ্ধতার মাঝেও মধ্যবিত্ত শ্রেণী খুঁজেন আপন শিশুর বিনোদন। কিন্তু বাস্তবে এ বিনোদন বিদঘুটে হয়ে উঠে ‘ওসমানী শিশু উদ্যান’ এর ভেতরের দৃশ্যে। এখানে শিশুর চেয়ে তরুণ তরুণী যুবক যুবতীদের আনাগোনা বেশী। অবস্থা দৃশ্যে মনে হয় অবাধ প্রেমকুঞ্জ। ৩০ টাকার টিকিট কেটে সারাদিন প্রেম। উদ্যানের কোণায় কোণায় বিভিন্ন ইভেন্টের আশেপাশে এসব তরুণ তরুণী ও যুবক- যুবতীদের প্রেমাচার চলে নির্বিঘ্নে। কিছু বলার কেউ নেই এখানে। শুধু কি তাই শিশুদেও বিভিন্ন রাইডার ও তারা দখল করে বসে। দায়িত্বরত কর্মচারীরা অতিরিক্তি টাকা পাবার আশায় এ সুযোগ করে দেয়। শিশুদের নিয়ে আসা অভিবাবকরা পড়েন বিপাকে। তরুণ তরুণীদের অবাঞ্চিত আচরণে কোমলমতি শিশুদের নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন অভিভাবকরা।
রয়েছে অবাঞ্চিত মহিলাদের বিচরণ। নানান রুপে সেঁজে এরা বিকৃত অঙ্গ ভঙ্গি করে। মহিলা পকেটমারদের উপদ্রব তো আছেই। ভীড়ের সময় মহিলাদের ভ্যানেটি ব্যাগ কিংবা হ্যান্ড ব্যাগ থেকে মোবাইল সহ মুল্যবান জিনিষপত্র ছিনিয়ে নেবার ঘটনা ঘটছে অহরহ।
এসব অসঙ্গতি ও অসুবিধার কথা দেখার বা শোনার কেউ নেই। পুরো উদ্যান চলে চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারী দিয়ে।
৩০ টাকার টিকিট করে যে কেউ এখানে প্রবেশ করতে পারে। এক্ষেত্রে শিশুদের অধিকার রক্ষা করা হয়নি। প্রতিটি ইভেন্ট বা রাইডার এওর জন্য আলাদা ১০ টাকার টিকিট করতে হয়। কিন্তু এই ইভেন্ট বা রাইডার কতসময় শিশু উপভোগ করতে পারবে তার কোন নিয়ম নীতি নেই। কর্মচারীর ইচ্ছার উপর নির্ভর শিশুর বিনোদন। অধিকাংশ ইভেন্ট অচল ময়লা আবর্জনাময়। যেগুলো চলে তাও আবার ঝুঁকিপূর্ণ।
বৃহস্পতিবার সরেজমিন এই উদ্যানে গেলে দেখা যায় নানা অসঙ্গতির দৃশ্য। যুবক যুবতীদের উপস্থিতি আর অবাধ মেলামেশার দৃশ্য ছিল লক্ষ্যনীয়। অনেকেই নিজেদের পরিচয় দেয় স্বামী স্ত্রী বলে। এমনি এক যুগল শিশুদের রাইডার চড়ছে অবলীলায়। তা দেখে তাদের কাছে জানতে চাইলে দৌঁড়ে পালিয়ে যায়। উদ্যানজুড়ে জোড়ায় জোড়ায় তরুণ তরুণীদের আপত্তিকর অবস্থান। এখানে না আছে পুলিশের ভয় না আছে পাবলিকের ভয় তাই অবাধে চলছে বেরেল্লাপনা।
ওসমানী শিশু উদ্যানের চলমান অবস্থা এই। অন্যদিকে এই উদ্যানটির প্রতিষ্ঠা ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে আছে নানান অভিযোগ। এসব নিয়ে সম্প্রতি দৈনিক মানবজমিনে চৌধুরী মুমতাজ আহমদ একটি শক্তিশালী প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। প্রভাতবেলা পাঠকদের জ্ঞাতার্থে তা হুবহু উপস্থাপন করা হল;
ধোপাদীঘি ও দীঘিরপাড়। সিলেট নগরীর একেবারে মাঝামাঝি এর অবস্থান। সব মিলিয়ে সোয়া ৬ একর জায়গা। যে কারোরই চোখ পড়তে পারে। আর সে চোখ যদি ব্যবসায়ী কারো হয় তবে তো আর পলকই পড়তে চাইবে না। সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের লাগোয়া এ বিশাল জায়গাটি খালি পড়ে থাকতে দেখে চোখ চকচক করে তার। আহা! এখানে যদি কোনো কিছু করা যেত। মিজান আজিজ চৌধুরী সুইটের সেই পলকহীন চোখের স্বপ্নের বাস্তব রূপ হয়ে সিলেটে ৬.২৩৬৫ একর জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বঙ্গবীর ওসমানী শিশু উদ্যান। সিলেট সিটি করপোরেশনের কাছ থেকেই জায়গাটি ইজারা নিয়েছিলেন মিজান আজিজ। তিন বছরের ভাড়া বকেয়া, ইজারার মেয়াদও শেষ। কিন্তু সিটি করপোরেশনের যেনো তা নজরেই পড়ছে না।
ধোপাদীঘিতে বাণিজ্যিকভাবে একটি শিশুপার্ক তৈরির ভাবনা আসার পর মিজান আজিজ যোগাযোগ করেন সে সময়কার সিলেট পৌরসভার সঙ্গে। যে কেউ চাইলেই তো আর কিছু দিয়ে দেয়া যায় না। তবে ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। সিলেট পৌর কর্তৃপক্ষের ইচ্ছে ছিলো। তাই তড়িঘড়ি করে একটি প্রকল্প তৈরি হয়। জায়গাটা তো পাইয়ে দিতে হবে মিজান আজিজ সুইটকে। পৌরসভার ‘উপলব্ধি’ হয় এই শহরে শিশুদের বিনোদনের জন্য কিছু নেই। তাদের জন্য একটা পার্ক তৈরি করলে কেমন হয়। নিজেরা করতে গেলে বিশাল বাজেটের প্রয়োজন। ১৯৯৯ সালের ৫ই জানুয়ারি তৎকালীন পৌর পরিষদের সভায় সিদ্ধান্ত হয় ধোপাদীঘির জায়গা পার্কের জন্য ইজারা দেয়া হবে। কাকে দেয়া হবে সেটা তো মনে মনে ঠিকই করা আছে। কিন্তু মনের খবর বাইরে বেরিয়ে গেলে তো সমস্যা। তাই অবতারণা হয় টেন্ডার নাটকের।
২০০১ সালের ২০শে মার্চ ইজারা প্রদানের জন্য টেন্ডার আহ্বান করে সিলেট পৌরসভা। জমা পড়ে ৫টি টেন্ডার। ১৫ই এপ্রিলের পৌর পরিষদের সভায় কুয়ারপারের ১ নং ফরিদাবাদের বাসিন্দা মিজান আজিজ সুইটকে ৫ বছর মেয়াদে ইজারা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২০০১ সালের ৯ই মে মিজান আজিজ চৌধুরী সুইটের সঙ্গে ইজারা চুক্তি সম্পাদন করে তৎকালীন সিলেট পৌরসভা।
৫ বছর মেয়াদে ইজারা পান মিজান আজিজ চৌধুরী সুইট। ইজারাদাতা সন্তুষ্ট থাকলে পরবর্তীতে মেয়াদ বাড়ানো হবে বলে চুক্তির শর্তে উল্লেখ থাকে। এমন অনিশ্চিত শর্তেই মিজান আজিজ শিশু পার্কের জন্য ৬ কোটি টাকা বিনিয়োগে সম্মত হন। তবে বিভিন্ন সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে, চুক্তির আগেই তাকে আশ্বস্ত করা হয়েছিলো পৌরসভা খুব সহজে ‘অসন্তুষ্ট’ হবে না। মিজান আজিজকে বুঝিয়ে দেয়া হয় ৬.২৩৬৫ একর ভূমি। সিটি করপোরেশন থেকে সরবরাহকৃত তথ্যে অবশ্য হিসাব মেলেনি পুরো জায়গার। সিটি করপোরেশনের দেয়া লিখিত তথ্যে হিসাব মেলে ৬.২৩৪১ একর ভূমির। এর মধ্যে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে পাওয়া ভূমির পরিমাণ ৩.৬১৭৮ একর আর অধিগ্রহণ করা হয় ২.৬১৬৩ একর ভূমি।
ইজারা চুক্তিতে মেয়াদান্তে মানসম্মত ভাড়া নির্ধারণের শর্ত থাকলেও দুই বার নবায়নের পরও বার্ষিক ভাড়া সেই একই থেকে গেছে। এ সময়ের মধ্যে পৌরসভা আমল পেরিয়ে সিটি করপোরেশন পর্বে পা দেয় সিলেট নগরী। নাগরিক জীবনের ব্যয় বাড়লেও ভাড়ার হার বাড়েনি মিজান আজিজের জন্য। ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা ভাড়াতেই ৩য় মেয়াদে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ইজারা নবায়ন করা হয়েছে।
ইজারার দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হয়েছিলো ২০১১ সালে। এরপর নবায়ন ছাড়াই দুই বছর ভোগ দখল করতে দেয়া হয় মিজান আজিজকে। তবে কি বাতিল করা হয়েছিলো ইজারা? সিটি করপোরেশন লিখিতভাবে মানবজমিনকে স্পষ্ট জানায় ‘মধ্য পর্যায়ে ইজারা বাতিল করা হয়নি’। এমনকি বাতিলও করা হয়নি নবায়ন। মিজান আজিজ নবায়নের আদেশ পেতে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। এর প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ২০শে জুন নবায়ন ফিসহ বকেয়া ভাড়া মিলিয়ে মোট ৪ লাখ ৮২ হাজার ৫শ’ টাকা গ্রহণ করে সিটি করপোরেশন। তবে কেনো দু’বছর পর্যন্ত ইজারা নবায়ন করা হয়নি বা ভাড়া আদায় করা হয়নি সে রহস্যের ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
২০১৩ সালের পর মিজান আজিজের কাছ থেকে আর একটি টাকাও বুঝে পায়নি সিটি করপোরেশন। এরপরও বকেয়া আদায় বা ইজারা বাতিলে কোনো পদক্ষেপও নেয়নি। যদিও ইজারা চুক্তির ৬ নং শর্তে বলা আছে, ‘একাধারে ১ (এক) বৎসর পর্যন্ত ভাড়া পরিশোধ করিতে ব্যর্থ হইলে ইজারাদাতা অত্র ইজারা চুক্তির অবসান ঘটাইয়া আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণ করিতে পারিবেন।’ বকেয়া থাকা অবস্থায়ই গত ৯ই মে ইজারার মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে; কিন্তু সিটি করপোরেশনের ঘুম এখনও ভাঙেনি, এখনও তাদের চোখে ‘সুইট ড্রিম’ই বোধহয় খেলা করছে।
বঙ্গবীর ওসমানী শিশু উদ্যান নিয়ে ধোঁয়াশা অনেক দিন ধরেই। চরম গোপনীয়তার কারণে তথ্য মিলছিলো না কোথাও। এমন প্রেক্ষিতে শিশু উদ্যানের সর্বশেষ অবস্থা জানতে চেয়ে মানবজমিনের পক্ষ থেকে ২০১৫ সালের ১২ই নভেম্বর চিঠি দেয়া হয়েছিলো সিলেট সিটি করপোরেশনে। ২৩শে নভেম্বর সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে প্রাপ্ত জবাবে ভূমি ইজারা সংক্রান্ত অনেক তথ্যই অস্পষ্ট থেকে যায়। সম্পূরক কিছু তথ্য জানতে চেয়ে ৬ই ডিসেম্বর মানবজমিনের পক্ষ থেকে আরেক দফা চিঠি দেয়া হয় সিটি করপোরেশনে। জবাব আসে ২৮শে ডিসেম্বর। কিন্তু তারপরও অনেক প্রশ্নের জবাবই অস্পষ্ট। যে কারণে কিছু রহস্যও রহস্যই থেকে গেছে। তিন বছর ধরে ভাড়া মিলছে না। কিন্তু কেনো ‘আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণ’ করছে না সিটি করপোরেশন। সুইটের সুইট হাসি-ই কি ভুলিয়ে রেখেছে সিটি করপোরেশনকে, না অন্য কোনো রহস্য এর পেছনে রয়েছে- তার শুলুক সন্ধান মেলেনি কিছুতেই।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।

সর্বশেষ সংবাদ