সিসিকে ‘ভৌতিক’ হোল্ডিং ট্যাক্স

প্রকাশিত: ৬:১৬ অপরাহ্ণ, মে ১২, ২০২৪

সিসিকে ‘ভৌতিক’ হোল্ডিং ট্যাক্স

আহমদ মারুফ :

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি। দফায় দফায় বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি। লাফিয়ে লাফিয়ে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পর এবার নগরবাসীর উপর ‘ভৌতিক’ হোল্ডিং ট্যাক্স-এর খড়গ। অস্বাভাবিক এই হোল্ডিং ট্যাক্স কারও বেড়েছে ২০০ গুণ। কারও ৫০০ গুণ। কারও এই সীমানাও ছাড়িয়ে গেছে! যিনি আগে দিতেন ৩০০০ টাকা, তার ওপর ট্যাক্স ধার্য্য হয়েছে ১৫০০০ টাকা। কারও বেলায় ঘটেছে তুঘলকি কারবার! ৮০০ টাকার বার্ষিক হোল্ডিং ট্যাক্স গিয়ে ঠেকেছে ১৮০০০ টাকায়!

এক লাফে হোল্ডিং ট্যাক্স-এর উত্তাপে নগরজুড়ে ক্ষোভ বিরাজ করছে। নতুন নির্ধারিত হোল্ডিং ট্যাক্সকে অযোক্তিক ও অনায্য দাবি করে তা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন বাসিন্দারা। শিগগিরই বিষয়টির সুরাহা না হলে নগরবাসী বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা করবে বলে জানিয়েছেন তারা।

হোল্ডিং ট্যাক্স বিষয়ে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন- ‘হোল্ডিং ট্যাক্সের জন্য দুই ধরণের অ্যাসেসমেন্ট (মূল্যায়ন) করা হয়। একটি জেনারেল অ্যাসেসমেন্ট, ৫ বছর পর পর হয়। আর আরেকটি অ্যাসেসমেন্ট করা হয় প্রতি বছর। সিসিকের রাজস্ব শাখার নিজস্ব লোক দিয়ে। তবে সিসিকে ২০০৫ সালের পর কোনো অ্যাসেসমেন্ট হয়নি। ২০০৫ সালের অ্যাসেসমেন্টের নির্ধারিত হোল্ডিং ট্যাক্স ২০০৭ সাল থেকে কার্যকর হয়। তবে ২০১১ সাল থেকে গণপূর্ত অধিদপ্তর (পিডব্লিউডি) কর্তৃক সিটি কর্পোরেশনের জন্য নির্ধারিত হোল্ডিং ট্যাক্স নগরবাসীর কাছ থেকে আদায় করা হতো। তবে বর্তমানে আরোপিত হোল্ডিং ট্যাক্সের অ্যাসেসমেন্ট ২০১৯-২০ অর্থবছরে করা হয় এবং এখন সেটি মহানগরের পুরাতন ২৭টি ওয়ার্ডের জন্য কার্যকর করা হয়েছে। আর নতুন ওয়ার্ডগুলোতে অ্যাসেসমেন্টের কাজ চলমান রয়েছে, শেষ হলে এসব ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের হোল্ডিং ট্যাক্সের পরিমাণ জানিয়ে দেওয়া হবে।’

সিসিক সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে নির্ধারিত হোল্ডিং ট্যাক্সের জন্য ফিল্ড সার্ভে হয় ২০১৯-২০ অর্থবছরে। ২০২১ সালের আগস্টে তৎকালীন সিসিক পরিষদের বিশেষ সভায় সেটি পাস হয়। কর ধার্য্যের অর্থবছর নির্ধারণ করা হয় ২০২১-২২ সাল। ওই অ্যাসেসমেন্টে মোট ৭৫ হাজার ৪শত ৩০ টি হোল্ডিংয়ে ১ শত তেরো কোটি ২৭ লক্ষ ৭ হাজার ৪ শত ৪৫ টাকা লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সেটি অনুমোদনের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হলে পরে ২০২১ সালের অক্টোবরে তা অনুমোদিত হয়।

আরও পড়ুন  এমসি কলেজে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ: ৩ আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি

সিসিকের সম্প্রতি আরোপিত হোল্ডিং ট্যাক্স অনুযায়ী ‘ইমারত ও জমির উপর কর ৭%, ময়লা নিষ্কাশন রেট ৭%, সড়কবাতি রেট ৭% ও পানি ৩%- এই মোট ২০%। অন্যদিকে, স্থাপনা পাকা হলে প্রতি বর্গফুট ৫, আধা-পাকা ৩, কলোনি ৫ ও বাণিজ্যিক ৭ টাকা।’

‘যদি কারো হোল্ডিং-এর ভাড়া মূল্য প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হয়, তবে নিজে ব্যবহারের ক্ষেত্রে কর ভিত্তি হিসাবের জন্য তার হোল্ডিং-এর বার্ষিক মূল্য হবে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা এবং হোল্ডিং ট্যাক্স-এর পরিমাণ হবে বার্ষিক ১২ হাজার টাকা। তবে সিসিক ছাড় দিয়েছে। যেমন- রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাবদ ২ মাসের ভাড়া মূল্যের সমপরিমাণ অর্থ (যদি) ১০ হাজার টাকা ধরা হয়েছে। এছাড়া মালিক নিজে ভবন ব্যবহার করলে, ভবনের বার্ষিক মোট মূল্য থেকে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাবদ অর্থ ছাড় দেয়ার পর অবশিষ্ট ভাড়া মূল্যের উপর আরও ৪০% ছাড় দেওয়া হয়েছে। সব ছাড়ের পর (মাসিক ভাড়া ১০ হাজার হিসাব ধরে) বার্ষিক ১ লাখ ২০ হাজার টাকা নয়, অর্ধেক ভাড়া অর্থাৎ- ৬০ হাজার টাকার করের ভিত্তি হিসাবে বার্ষিক হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ করা হয়েছে।’

২১ নম্বর ওয়ার্ডে বসবাসকারী পিন্টু চন্দ্র (৩৫) একটি সেলুনে কাজ করেন। তিনি বছরে হোল্ডিং ট্যাক্স দিতেন ১ হাজার ২০০ টাকা । নতুন অ্যাসেসমেন্টে এটা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫৪ হাজার টাকা অথাৎ শতকরা প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ভাগ ট্যাক্স বাড়ানো হয়েছে। তিনি কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, আমরা নিম্ন আয়ের মানুষ। টিনের ঘরে বসবাস করি। বছরে এতো টাকা কীভাবে পরিশোধ করব? ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে বসবাসকারী আফরোজ খানের বার্ষিক হোল্ডিং ট্যাক্স ছিল ৩ হাজার ৮৬ টাকা। নতুন অ্যাসেসমেন্টে এটা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৬০০ টাকা । শতকরা হারে প্রায় ৫ হাজার ভাগ। তিনি জানান, অ্যাসেসমেন্টের লোকজনের সম্ভবত তখন ‘চেতনা’ ছিলেন না।

এমন অভিযোগ নগরের প্রায় সব ভবন মালিকদেরই। পুননির্ধারিত হোল্ডিং ট্যাক্স সম্পর্কে অবহিত ও আপত্তিগ্রহণ করতে নগর ভবনের সামনে আলাদা বুথ স্থাপন করেছে সিসিক। প্রায় প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ এই বুথে ভিড় করছেন। তারা সবাই নতুন নির্ধারিত হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।

আরও পড়ুন  ৬ জেলায় করোনায় আরো ৭০ জনের প্রাণহানি

নগরের ২৬ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা রফিকুল হক হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধির হারে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, নগরের প্রায় পৌনে এক লাখ ভবনমালিকের হোল্ডিং ট্যাক্স ৫ থেকে ৫০০ গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এটা নগরবাসীর উপর এক ধরণের জুলুম। একলাফে এতোটা কর বাড়তে পারে না। এই অনায্য কর বাতিলের দাবি জানান তিনি।

অস্বাভাবিক ‘ভৌতিক’ এই ট্যাক্স নিয়ে জনমনে ব্যাপক ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলেও সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এখনো কোনো মন্তব্য করেননি বা প্রেসনোটও দেননি।

সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী তার বাসভবনে এক সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছেন, বিষয়টি নগরবাসীর সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করা যেতে পারে। তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশনের ভিতর ঘাপটি মারা আমলারা এই অস্থিরতা তৈরি করেছেন।

হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে এমন অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত মেয়রকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বিষয়টি নিয়ে প্রথমে নগরবাসীর সঙ্গে সিসিক মতবিনিময় করে শতকরা কতভাগ ট্যাক্স বাড়াবে তা নির্ধারণ করতে পারত। তবে সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি, বর্তমান হোল্ডিং ট্যাক্সের কার্যক্রম স্থগিত করে সকলের মতামতের ভিত্তিতে হোল্ডিং ট্যাক্সের হার নির্ধারণ করতে হবে। যারা হোল্ডিং ট্যাক্স দেয় তাদের উপর বোঝা না চাপিয়ে নতুন ট্যাক্সদাতা তৈরি করা উচিত।

লেখক: কবি-সাংবাদিক

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।

সর্বশেষ সংবাদ