হাজার বছরের ঐতিহ্য ‘পালকি’

প্রকাশিত: ৭:২১ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ৭, ২০২৩

হাজার বছরের ঐতিহ্য ‘পালকি’

খন্দকার মাজেদুল ইসলাম : 

‘হুন হুনা হুন হুনরে’ বা ‘চার বেহারার পালকি চড়ে যায় রে কন্যা পরের ঘরে’। পালকির বেহারাদের এই ছন্দ তোলা গানগুলো এখন আর শুনতে পাওয়া যায় না গ্রাম বাংলার মেঠোপথে। হাজার বছরের ঐতিহ্য পালকিকে এখন আর মেঠোপথে চলতেও দেখা যায় না। কালের বিবর্তনে পালকি জাদুঘর ও বইয়ের পাতায় স্থান পেয়েছে।

 

নতুন প্রজন্মের সঙ্গে পালকির পরিচয় নেই বললেই চলে। তারা পালকির কথা বইয়ের পাতায় এবং লোক ও কারু জাদুঘরে গিয়ে দেখতে ও শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু আগের দিনে বিয়ের বরযাত্রায় পালকির ছিল একটি ভিন্ন জলুস। বর পালকি চড়ে কনের বাড়ি যেত, আবার কনেও পালকি চড়ে শ্বশুরবাড়ি আসত।

 

পালকি হিন্দি শব্দ। পালকি মানুষ চালিত চাকাবিহীন একটি বাহন। উপমহাদেশে পালকির প্রচলন কখন হয়েছিল তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। তবে পালকির উৎপত্তির সঠিক ইতিহাস জানা না গেলেও ‘বাল্মীকির রামায়ণে’ পালকির উল্লেখ রয়েছে। তাই ধারণা করা হয়, হাজার হাজার বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশে পালকির প্রচলন ছিল। শুধু ভারতীয় উপমহাদেশেই নয়, এর বাইরেও বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে পালকির প্রচলন ছিল। প্রাচীন রোমে পালকিকে বলা হতো লেটিকা, চীনে জিয়াও, ভিয়েতনামে কিউ, ইংল্যান্ডে সিড্যান চেয়ার, স্পেনে লিটারা, ফ্রান্সে পালানকুইন, পর্তুগালে লিটেইরা, থাইল্যান্ডে ওহ, কোরিয়ায় গামা, জাপানে নোরিমোনো ও তুরস্কে টাহটিরেভান ইত্যাদি নামে পালকি পরিচিত ছিল। এমনকি ব্রিটেনের রাজা ও লেখক অষ্টম হেনরি আমৃত্যু পালকিতে চড়েছেন বলে জানা যায়।

 

আরও পড়ুন  ‘ এই মসজিদে তাঁর হাজারো স্মৃতি রয়েছে’

সাধারণত একটি বা দুটি লম্বা বাঁশ বা কাঠের দণ্ডে বড় চেয়ার বা খাট ঝুলিয়ে এবং কাঠ, বাঁশ বা কাপড় দিয়ে আবৃত করে পালকি তৈরি করা হতো। পালকি দেখতে অনেকটা কাঠের বাক্সের মতো। প্রতিটি পালকির দৈর্ঘ্য ৬ ফুট ও প্রস্থ তার অর্ধেক। কাঠামো লম্বা ও দুই পাশে বাঁশের সাহায্যে গাঁথা। পালকির ওপরে দামি কাপড় দ্বারা মোড়ানো হয়। পালকি বহনকারীদের ডাকা হতো ‘কাহার’ বা ‘বেহারা’ নামে। প্রতিটি পালকি চালাতে চারজন বেহারা বা কাহার প্রয়োজন হতো।

 

একসময় পালকি আমাদের দেশের জাতি, ধর্মবর্ণ, ধনী-গরিব সবার কাছে সমান পছন্দনীয় বাহন ছিল। তখন আবার সব পরিবারে পালকি ছিল না। বিত্তশালী, জমিদার ও উচ্চবংশীয় লোকদের প্রত্যেকের বাড়িতে পালকি ছিল। সে সময় পালকি বংশের মর্যাদার প্রতীক হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। নিম্নবিত্ত পরিবারের লোকদের বাড়িতে পালকি ছিল না। তাই তাদের জন্য ছিল অন্য ব্যবস্থা। তারা বিভিন্ন প্রয়োজনে পালকি ভাড়া করত অর্থ বা কড়ির বিনিময়ে। কিন্তু বিয়ে বা যে কোনো উৎসবে পালকি থাকতেই হতো।

 

পালকি আমাদের দেশের হাজার বছরের পুরোনো ঐতিহ্য। পালকি নিয়ে লেখা হয়েছে গান, ছড়াসহ হাজারো কবিতা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তসহ অনেক কবি পালকি নিয়ে লিখেছেন। পালকি চলার সময় বেহারারা ‘হুন হুনা হুন হুনরে’ বা ‘চার বেহারার পালকি চড়ে যায় রে কন্যা পরের ঘরে’ এসব গান গাইত। এ ছাড়া ‘পালকি চলে, পালকি চলে, গগনতলে আগুন জ্বলে’… আরও সুন্দর ছন্দবদ্ধ কথা ‘… তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে …’।

আরও পড়ুন  বাহুবলে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪ কলেজ শিক্ষার্থী আহত

 

সে সময় পালকির কথা সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন বিশ্বখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তার এ দেশে আসা ভ্রমণকাহিনী ‘রোহেলা’য়। তিনি পালকি বহনের দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন।

 

এ ছাড়া সমাজের জ্ঞানী-গুণী মানুষকে বরণ করতে সে সময় পালকির বিকল্প যেন পালকিই ছিল। আমাদের দেশে এমন এক সময় গেছে, যখন বিয়ের অনুষ্ঠান পালকি ছাড়া হতোই না, পালকি ছাড়া বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলে যেন নিজেদের হতভাগা বলে মনে হতো। পালকি ঘিরে অনেক লোক জীবিকা নির্বাহ করত।

 

সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যখন নতুন প্রজন্ম লোকশিল্প জাদুঘরে গিয়ে সাজানো গোছানো কৃত্রিম পালকি দেখবে। পালকির সেই ঐতিহ্যময় হাজার বছরের ব্যবহার ক্রমে গ্রাস করেছে যান্ত্রিক সভ্যতার বিদেশি বিভিন্ন রঙের বাহারি গাড়ি। পালকি বহনের দৃশ্য এখন যেন অনেকটাই স্বপ্ন। সেই সঙ্গে হারিয়ে গেছে ছন্দমাখা পালকি বহনের গানও।
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।

সর্বশেষ সংবাদ