সিসিক’র ১২ কোটি টাকার কাজ|| সনদে আছে, বাস্তবে নেই

প্রকাশিত: ১:৩৮ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৩০, ২০২৫

সিসিক’র ১২ কোটি টাকার কাজ|| সনদে আছে, বাস্তবে নেই

প্রভাতবেলা প্রতিবেদক♦ সিসিক’র ১২ কোটি টাকার কাজ|| সনদে আছে, বাস্তবে নেই। আজগুবি এই ১২ কোটি টাকার অস্তিত্বহীন কাজের সনদ দিয়েছে সিসিক। অথচ সিলেটের বাস ও ট্রাক টার্মিনাল আধুনিকায়নে সিএসআরের আওতায় এরকম কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের অস্তিত্বই নেই।

সিলেট কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল ও সিলেট ট্রাক টার্মিনালে স্বয়ংক্রিয়ভাবে টোল আদায়, যানবাহন প্রবেশ ও বহির্গমন মনিটরিং, ভারি যানবাহনের ওজন পরিমাপ, ‘রিয়েল টাইম আপডেট’ ট্রাফিক সিস্টেম স্থাপন এবং আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স ব্যবহার করে সিসিটিভি ক্যামেরা পরিচালনায় ১২ কোটি টাকার কাজ করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মো. জামিল ইকবাল- এই মর্মে সনদপত্র প্রদান করেছে সিলেট সিটি করপোরেশন।

২০ এপ্রিল সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমানের সই করা পত্রে ১২ কোটি টাকার কাজ সম্পাদনের সত্যতা নিশ্চিত করা হয়।

করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার (সিএসআর) নিজস্ব ফান্ড থেকে এই কাজটি করেছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মো. জামিল ইকবাল। কাজটি সম্পন্ন করায় সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর স্বাক্ষরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে একটি অভিজ্ঞতার সনদও প্রদান করা হয়েছে।

বাস টার্মিনালের কাজ শেষ হলেও সেখানে পরিবহন শ্রমিকরা নিজেদের মতো করে ব্যবস্থাপনার কাজ করছেন। আর ট্রাক টার্মিনালের জায়গা নির্ধারণ ছাড়া তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।

কিন্তু কোনো কাজ না করেও বাস ও ট্রাক টার্মিনালে ১২ কোটি টাকার কাজ হয়েছে উল্লেখ করে সিসিকের কার্য সম্পাদন সনদ বাগিয়ে নিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মো. জামিল ইকবাল। এই সনদ জালিয়াতিতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সিলেট সিটি করপোরেশনের যোগসাজশ রয়েছে বলে জানা গেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে অর্জন করা সনদ দিয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের কয়েকটি টোল প্লাজা ইজারা নেওয়ার চেষ্টা করছে মেসার্স মো. জামিল ইকবাল। অটোমেটেড ওয়েব বেইজড টোল কালেকশন নিয়ে অন্য কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এই অভিজ্ঞতা না থাকায় দরপত্রে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এককভাবে এগিয়ে রয়েছে জামিল ইকবালের প্রতিষ্ঠান। যার কারণে অন্যান্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে।

আরও পড়ুন  সুষ্ঠু নির্বাচনে আমরা বদ্ধপরিকর : সিইসি

সড়ক ও জনপথ বিভাগের তথ্যমতে, সিলেট বিভাগের শেরপুর, ছাতক, রাণীগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ ও শাহপরাণ টোল প্লাজা ইজারা দেওয়ার জন্য মার্চ মাসে দরপত্র আহ্বান করে সড়ক ও জনপথ। এর মধ্যে শেরপুরে ১২টি, ফেঞ্চুগঞ্জে ১০টি ও শাহপরাণে ১৩টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দিয়েছে। বিভাগের বাকি টোল প্লাজাগুলোতেও দরপত্রে অংশ নিয়েছে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।

সূত্র জানায়, প্রায় সবগুলো টোলপ্লাজার ইজারা নেওয়ার জন্য দরপত্র জমা দেয় মেসার্স মো. জামিল ইকবাল নামক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। দরপত্রের সঙ্গে ‘রিয়েল টাইম কাস্টমাইজড সফটওয়্যার বেসড কম্পিউটারাইজড টোল কালেকশনের’ অভিজ্ঞতা হিসেবে তারা সিসিকের ১২ কোটি টাকার কাজের একটি অভিজ্ঞতা সনদ সঙ্গে জমা দেয়। বিষয়টি জানাজানি হলে দরপত্রে অংশ নেওয়া অন্যান্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। সড়ক ও জনপথের পক্ষ থেকে গত ২৫ মার্চ ওই সনদের সত্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলীকে একটি পত্র পাঠানো হয়।

এরই জবাবে গত ২০ এপ্রিল সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমানের সই করা পত্রে ১২ কোটি টাকার কাজ সম্পাদনের সত্যতা নিশ্চিত করা হয়।

সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী ওই পত্রে উল্লেখ করেন, সিলেট সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন বাস ও ট্রাক টার্মিনাল ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কার্যসম্পাদন সনদ সিসিক থেকেই দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও পত্রে উল্লেখ করা হয়, মেসার্স মো. জামিল ইকবালের নিজস্ব সিএসআর ফান্ড থেকে অটোমেটেড ওয়েব-বেসড টোল কালেকশন খাতে ৯ কোটি টাকা, ট্রাফিক অ্যান্ড টার্মিনাল অপারেশনস খাতে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা, এনহ্যান্সড সার্ভিলেন্স মনিটরিং খাতে ৮০ লাখ টাকা ও ফিচারর্স ফর দি টোল কালেকশন সিস্টেম খাতে ১ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সর্বমোট ১২ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। ২০২৩ সালের ১০ আগস্ট কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

আরও পড়ুন  ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অভিবাসীদের ধরপাকড় বন্ধ

সরজমিনে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাস ও ট্রাক টার্মিনালে এরকম কোনো প্রকল্পই বাস্তবায়ন হয়নি। সিএসআরের তহবিল আত্মসাৎ ও অভিজ্ঞতার সনদ হাতিয়ে নিয়ে কাজ না করেই সিসিকের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সার্টিফিকেট নিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি।

সিলেট জেলা পরিবহন সংশ্লিষ্টরা প্রভাতবেলাকে জানান, বাস টার্মিনালটি পরিবহন সমিতির একজন নেতা ইজারা নিয়েছেন। তিনি ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে লোকবল দিয়ে টাকা আদায় করছেন। তাছাড়া যানবাহন প্রবেশ ও বহির্গমনে কোনো কম্পিউটারাইজড সিস্টেম চালু করা হয়নি। এমনকি এ ধরনের কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে বলেও সিসিক কাউকে জানায়নি।

এ বিষয়ে জানতে মেসার্স মো. জামিল ইকবালের স্বত্বাধিকারী মো. জামিল ইকবালের মুঠোফোনে কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি সাড়া দেননি।

এ ব্যাপারে সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান  জানান, সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর সময়কালে মেসার্স মো. জামিল ইকবালের সঙ্গে সিসিকের একটি চুক্তি হয়েছিল। ওই চুক্তি অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি বাস ও ট্রাক টার্মিনালের টোল আদায়ে অটোমেশন পদ্ধতি, ওয়েব্রিজের ব্যবহার ও নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেছে। তারা একটি রিপোর্ট সিসিককে জমা দিয়েছে। মূলত তারা একটি সার্ভের কাজ করেছে। কোনো স্টাবলিশমেন্টের কাজ হয়নি। সার্ভেতে সিসিকের কোনো প্রকৌশলীকে রাখা হয়নি। তারা তাদের নিজস্ব লোক দিয়ে কাজ করেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সওজ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আমির হোসেন প্রভাতবেলা কে বলেন, দরপত্রে রিয়েল টাইম কাস্টমাইজড বেইসড অটোমেশনের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে। এই পদ্ধতিতে যাদের টোল আদায়ের অভিজ্ঞতা ভালো আছে, তাদেরকে সনদ জমা দিতে বলা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র নিয়ে সন্দেহ হলে সত্যতা যাচাইয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে চিঠি পাঠাবে মূল্যায়ন কমিটি। পরবর্তীতে মূল্যায়ন কমিটিই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে।

 

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।

সর্বশেষ সংবাদ