সিলেট ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ |
প্রকাশিত: ৭:৩৯ অপরাহ্ণ, জুন ১৮, ২০২০
কাজী হায়াৎ:
জীবনের শেষ পরিণতি মৃত্যু। একটু জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই কথাটা বুঝতে শিখেছি। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়টাই একটি জীবের জীবন। আমার বয়স এখন চুয়াত্তর। সেই হিসাবে বাস্তবতা এবং অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে হয়, আমার জীবন আর বেশিদিন স্থায়ী হবে না। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দেখে গেলাম, পৃথিবীর মানুষ করোনাভাইরাসে কতটা অসহায় হয়ে গেছে। পৃথিবীকে এমন একটা হোঁচট খেতে দেখে খুব কষ্ট হচ্ছে। কীভাবে, কতদিন পরে আমার মৃত্যু হবে তা জানি না; তবে মৃত্যুর আগে কিছুটা দুর্বিষহ জীবন নিয়ে গেলাম। কোথাও কোনো আঘাত বা কাটাছেঁড়া হলে অনেক সময় অনেক যন্ত্রণা হয়। আমেরিকায় হার্টের রিং বসানোর সময় লেনোকসিল হাসপাতালে আমার শরীরে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হয়েছিল। অনেক রক্ত জমে গিয়েছিল তলপেটে। মৃত্যুর হাত থেকে কোনোরকমে বেঁচে গিয়েছিলাম।
এক মাস পর্যন্ত পেটের নিচের অংশে ছিল প্রচণ্ড যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণা এবং যে কোনো সময় মৃত্যু হতে পারে- এমন অবস্থায় হাসপাতালের বেডে শুয়েও অনেক স্বপ্ন দেখতাম। আমার বাংলাদেশে আবার ফিরে যাব, আবার সিনেমা বানাব। শুটিং হবে- লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন, কাট। সিনেমা হলে হাউসফুল বোর্ড। হলভর্তি দর্শকের হাততালি। এফডিসিতে আমার প্রিয় সমিতির সভাকক্ষে আড্ডা, গল্প অথবা আমি ক্যামেরার সামনে অন্য কোনো পরিচালকের উদ্দেশে আঙুল উঁচু করে বলব- না, না; তোমরা যত যাই বলো, জয় আমাদের হবেই। অথবা যেদিন পদ্মা সেতু দিয়ে প্রথম মানুষ চলাচল শুরু হবে, সেদিন ওই সেতুর ওপর দিয়ে চলে যাব মধুমতির পারে, বাঁশঝাড়ের পাশে আম-জাম-সুপারি বাগানের ছায়ায় ঘেরা আমাদের গ্রামের বাড়িতে; যেখানে পাখির কিচিরমিচির ডাকে এখনও ঘুম ভাঙে। যেখানে এখনও টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ শোনা যায়। দেখা হবে কিশোরকালের বন্ধুদের সঙ্গে। তাড়াইল বাজারে গিয়ে চা খাব ইয়ার আলীর দোকানে।
আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক সহযোগিতা পেয়েই আমেরিকায় গিয়ে চিকিৎসা করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আর সেজন্যই হয়তো বেঁচে আছি আজও। ২০২০ সালের জুন চলছে। শরীরে এখন আর কোনো যন্ত্রণা নেই। তেমন কোনো অসুস্থতাও নেই। তবুও বেঁচে থাকা যে এত বিরক্তিকর ও যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে, তা জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসে অনুভব করে গেলাম। ভয়াবহ করোনার জন্য সমাজবিচ্যুত হয়ে বেঁচে আছি। পবিত্র ঈদেও কোনো প্রিয়জন আমার কাছে আসেনি। আমিও পারিনি কোথাও কোনো সতীর্থ অথবা প্রিয়জনের কাছে যেতে। বিছানায় শুয়ে এখন আর ভাবতে পারি না সিনেমার কোনো নতুন গল্প। আমার সামনের দিনগুলোর জন্য নেই পরিকল্পনা, নেই কোনো স্বপ্ন। যে পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, সেখানে দারুণ আনন্দ হতো। বয়সের আধিক্যজনিত কারণেও এই পেশায় নেই কোনো অবসরকাল। একজন হেডমাস্টার অথবা সরকারি, আধা-সরকারি কর্মচারীদের মতো কর্মক্ষম সুস্থ থাকা সত্ত্বেও একগুচ্ছ ফুল, একটা ছাতা, একটা লাঠি আর চোখের জল নিয়ে আমাকে কর্মস্থল থেকে বিদায় নিতে হবে না। অথচ কী নিদারুণ দুঃখের বিষয়- করোনাভাইরাস বোধহয় আমাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়ে দিল। বারবার মনে হয়, বোধহয় সুস্থভাবে বেঁচে থেকেও সিনেমার শেষ টাইটেল প্লেটের মতো হয়ে গেলাম ‘দ্য এন্ড’।
বিনোদনও মানুষের জীবনে একটা বিরাট খাদ্য। তাই বোধহয় আমাদের সিনেমার বেলায় অপ্রিয় হলেও কিছু কথা প্রচলিত ছিল, তা হল- ছবিটা দর্শকরা খাইছে ভালো। সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখে যে বিনোদন, আনন্দ অথবা দর্শকরা যা খেত, তা বোধহয় মানুষের কাছে একসময় গল্পকথাই হয়ে থাকবে। একজন আরেকজন থেকে ৬ ফুট দূরত্বের স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিয়ে আর কি কখনও কোনো সিনেমা হল চালু হবে? সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখার যে আনন্দ, তা কি বাংলাদেশের মানুষের জীবন থেকে চলেই যাবে? সিনেমা প্রদর্শনের জন্য নির্মাণ থেকে প্রদর্শন পর্যন্ত যারা কাজ করতেন, তারা কি সবাই চিরকালের জন্য বেকার হয়ে গেলেন? সিনেমা হল কর্তৃপক্ষ হয়তো সিনেমা হল ভেঙে বিপণিবিতান অথবা বহুতলবিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করে তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন। বাংলাদেশের কোনো ব্যাংক এবং ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সহযোগিতা ছাড়াই সিনেমা নির্মাণের জন্য যারা অর্থলগ্নি করতেন, সেই উদ্যোক্তারাও হয়তো এই সেক্টরে অর্থলগ্নি না করে অন্য কোনো সেক্টরে অর্থলগ্নি করবেন। কিন্তু যেসব মেধাবী শিল্পী-কলাকুশলীরা এই কর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তারা কী করবেন?
এই মুহূর্তে করোনাভাইরাস বিভিন্ন খেলার খেলোয়াড়দেরও হয়তো বেকার করে দিয়েছে। কিন্তু খেলোয়াড়দের স্বপ্ন আছে- স্টেডিয়ামে দর্শক ছাড়াই হয়তো অল্প কিছুদিনের মধ্যে আবার খেলা শুরু হবে। করোনাভাইরাসের নতুন নতুন গতিপ্রকৃতি দেখে সিনেমা নির্মাতাদের মধ্যে লালিত স্বপ্ন বোধহয় হারিয়ে যেতে চলেছে। তাহলে কী হবে? যেমন জানা নেই, করোনা কবে শেষ হবে! তেমনি জানা নেই, বাংলাদেশের প্রধান একটি বিনোদন মাধ্যম সিনেমার কী হবে?
তবুও অনেক আশা- প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর অন্ধকার পেরিয়ে যেমন নতুন সকাল হয়, তেমিন আবার সকাল হবে। সেই সকালে খবর পাব, কোভিড-১৯ নিরাময়ের জন্য শতভাগ সাফল্য নিয়ে নতুন ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। খবর পাব, শতভাগ সাফল্য নিয়ে এখন ভ্যাকসিন পাওয়া যাচ্ছে সারা পৃথিবীতে। আবার আমরা সবাই চলে যাব আমাদের কর্মস্থলে। না, ‘দ্য এন্ড’ নয়; আবার শুটিং হবে, আবার হবে অ্যাকশন-কাট। সেই সকালে ঈদের দিনের মতো আবার বুকে বুক মিলিয়ে হবে কোলাকুলি। মুখে মাস্ক নয়, সামাজিক দূরত্ব নয়; আমরা সবাই আবার হব আমাদের…
কাজী হায়াৎ : চিত্রপরিচালক
সম্পাদক : কবীর আহমদ সোহেল
নির্বাহী সম্পাদক: মোঃ আব্দুল হক
ঢাকা অফিস : ২৩৪/৪ উত্তর গোড়ান, খিলগাঁও, ঢাকা ।
সম্পাদক কর্তৃক প্রগতি প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং লিঃ, ১৪৯ আরামবাগ, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।
সিলেট অফিস: ২৩০ সুরমা টাওয়ার (৩য় তলা)
ভিআইপি রোড, তালতলা, সিলেট।
মোবাইল-০১৭১২-৫৯৩৬৫৩, ০১৭১২-০৩৩৭১৫
E-mail: provatbela@gmail.com,
কপিরাইট : দৈনিক প্রভাতবেলা.কম
আমাদের সর্ম্পকে গোপনীয়তা যোগাযোগ
Design and developed by ওয়েব হোম বিডি