৭ জুন : ঢাবি’র স্বপ্নদ্রষ্টা নবাব সলিমুল্লাহর জন্মদিন আজ

প্রকাশিত: ২:১৩ অপরাহ্ণ, জুন ৭, ২০২০

৭ জুন : ঢাবি’র স্বপ্নদ্রষ্টা নবাব সলিমুল্লাহর জন্মদিন আজ

 

প্রভাতবেলা ডেস্ক:

পূর্ববঙ্গবাসীর স্বার্থ আদায়ে বিশ শতকের গোড়ার দিকে যিনি নেতৃত্বের হাল ধরেন, তিনি হলেন নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ। জন্ম ৭ জুন ১৮৭১। তাঁর বাবা ছিলেন নওয়াব স্যার আহসানুল্লাহ (১৮৪৬-১৯০১) এবং দাদা ছিলেন নওয়াব স্যার আবদুল গনী (১৮১৩-১৮৯৬)। জমিদার পরিবার হিসেবে পূর্ববঙ্গে এই পরিবারের নাম ছিল অগ্রগণ্য। সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর ‘স্যার ফিলিপ হার্টগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য’ গ্রন্থে ঢাকার এই নবাব পরিবার সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন, ‘নবাবেরা ছিলেন ধর্মভীরু কিন্তু আধুনিক ও সংস্কারমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক এবং হিন্দুদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন। সে জন্য বড় বড় হিন্দু নেতা ও নগরের গোটা হিন্দু সম্প্রদায় নবাবদের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন।’

 

পূর্বপুরুষের আর্থিক স্থিতিশীলতা নওয়াব সলিমুল্লাহর সময়ে এসে ব্যাহত হয়েছিল। ১৮৯৩ সালে তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি নেন। ১৯০১ সালে পিতার মৃত্যুর পর নওয়াব এস্টেটের কর্তৃত্ব লাভ করেন। নওয়াব হিসেবে দায়িত্ব পালনের শুরুতেই ঢাকার সব মহল্লায় তিনি স্থাপন করেছিলেন নৈশ বিদ্যালয়। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ১৯০২ সালে সিএসআই; ১৯০৩ সালে নওয়াব বাহাদুর; ১৯০৯ সালে কেসিএসআই এবং ১৯১১ সালে জিসিএসআই উপাধি প্রদান করে। পূর্ববাংলার ভাগ্যহত মানুষের উন্নতি এবং পশ্চাৎপদ জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে তিনিই প্রথম স্বতন্ত্র প্রদেশ সৃষ্টির দাবি জানান। তাঁর দাবি অনুযায়ী ইংরেজ সরকার ১৯০৫ সালে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ’ সৃষ্টি করে ঢাকাকে এর রাজধানী ঘোষণা করেছিল।শহর ঢাকার সম্মানিত নাগরিকদের সঙ্গে নওয়াব সলিমুল্লাহ (১৯০২)।

 

নওয়াব সলিমুল্লাহ অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে চেয়েছেন পূর্ব বাংলায় একটি জ্ঞানবিভাসিত মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে উঠুক, বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া বাঙালি মুসলমানের মধ্যে। ১৯০৬ সালের ২৭-২৯ ডিসেম্বর শাহবাগ বাগানবাড়িতে অনুষ্ঠিত ‘অল-ইন্ডিয়া মোহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্স’। এর ২০তম সভায় দেওয়া তাঁর ভাষণের ক্ষুদ্রাংশ পাঠ করেও সলিমুল্লাহর চিন্তার ধারা গভীরভাবে উপলব্ধি করা যায়, ‘…আমাদের শিক্ষার অবস্থা খুবই শোচনীয়। কলকাতায় ৩ জন অশিক্ষিতের অনুপাতে ১ জন শিক্ষিত, অথচ ঢাকায় ৮ জন অশিক্ষিতের অনুপাতে মাত্র ১ জন শিক্ষিত লোক রয়েছে। … অন্য কথায়, সমগ্র বঙ্গে প্রতি ১৬ জন মুসলমানের মধ্যে ১৫ জনই অশিক্ষিত। এতে আপনারা অনুধাবন করতে পারবেন যে, আমরা তথা মুসলমানরা শিক্ষায় কত পশ্চাৎপদ।…’ উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রায় দেড় হাজার ডেলিগেট, পাঁচ শতাধিক দর্শকসহ মোট প্রায় দুই হাজার লোক এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। যাবতীয় ব্যয় বহন করেন সলিমুল্লাহ।

আরও পড়ুন  ৯ ডিসেম্বর : সাঁথিয়া,দাউদকান্দি, গাইবান্ধা, তিতাসে উড়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা

 

সম্মেলন শেষে ৩০ ডিসেম্বর সলিমুল্লাহর প্রস্তাবে গঠিত হয় ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’। নতুন প্রদেশ গঠনের সময় থকেই নওয়াব সলিমুল্লাহ, নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ অন্য নেতাদের দাবি ছিল ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার। গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা সফরে আসেন। সলিমুল্লাহসহ সহযোগী নেতারা হার্ডিঞ্জের সঙ্গে দেখা করলে তিনি আশ্বাস দেন, প্রদেশ বাতিলের ক্ষতিপূরণস্বরূপ ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। ঢাকার মতো একটি অবহেলিত ও অনগ্রসর প্রাচীন নগরীতে একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি তখন অনেকের কাছেই ছিল অযৌক্তিক। কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, সমাজসংস্কারক, প্রশাসকসহ গত ৯৮ বছরে যে বিদ্বৎসমাজ তৈরি হয়েছে, তার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা নওয়াব সলিমুল্লাহর অবদান অনস্বীকার্য।

 

নওয়াব সলিমুল্লাহকে নিয়ে বেশ কিছু শ্রুতি বা মিথ রয়েছে। তাঁর জীবন ও কর্ম পর্যালোচনায় সেগুলোর সত্যাসত্য অনুসন্ধানটাও জরুরি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সলিমুল্লাহ ৬০০ একর জমি দান করেছেন, এমন একটি গুঞ্জন ও মুখরোচক আলোচনা মুখপুস্তিকার দেয়ালগুলোতে দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে দান করার মতো জমি নওয়াব পরিবারের ছিল না। বাংলাপিডিয়ার তথ্যানুযায়ী, বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনার আওতায় পূর্ববাংলা ও আসাম সরকারের প্রশাসনিক দপ্তর প্রতিষ্ঠার জন্য রমনা এলাকায় এর আগে অধিগ্রহণ করা ২৪৩ একর ভূমি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নির্ধারিত হয়। সে সময়কার ভূমিসংক্রান্ত পরিপূর্ণ রেকর্ড ঢাকা কালেক্টরেটে রয়েছে। আরেকটি বিষয় এখানে আলোচনা করা প্রাসঙ্গিক। সার্বিক উন্নয়নের জন্য ১৮৮৮ সালে নওয়াব আহসানুল্লাহ বর্তমান বঙ্গভবন ও দিলকুশা এলাকার একটি বিস্তীর্ণ এলাকা সরকারের কাছ থেকে লিজ নিয়ে সেখানকার ঝোপঝাড়, গর্ত-টিলা পরিষ্কার করেন। পরবর্তী সময়ে যার একটি অংশ পল্টন ময়দান নামে পরিচিতি পায়। ধারণা করা যায় যে, এইরূপ লিজের জমিগুলো আপামর জনতা হয়তো নওয়াব পরিবারের বলেই জানত। ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ-এর লেখা ‘নওয়াব সলিমুল্লাহ্’ গ্রন্থে নওয়াব পরিবার কর্তৃক দান ও অনুদানের একটি সংক্ষিপ্তসার দেওয়া আছে।

 

মুসলিম হল, ইসলামিয়া এতিমখানা, মিটফোর্ড হাসপাতাল ও সার্ভে স্কুল প্রতিষ্ঠার সঙ্গেও সলিমু্ল্লাহ নামটিকে ঘিরে বেশ কিছু জনশ্রুতি রয়েছে। ইতিহাসের স্বার্থেই ইতিহাসের সত্যগুলো আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। পূর্ব বাংলার মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে নওয়াব সলিমু্ল্লাহর নানামুখী অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্রদের প্রথম ছাত্রাবাসের নাম রাখা হয় ‘সলিমুল্লাহ মুসলিম হল’। সলিমুল্লাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ইসলামিয়া এতিমখানাটি তাঁর মৃত্যুর পর নামকরণ করা হয় ‘সলিমুল্লাহ এতিমখানা’। রবার্ট মিটফোর্ড নামে ঢাকার এক সাবেক জেলা প্রশাসকের প্রদত্ত অর্থ দিয়ে ১৮৫৮ সালে মিটফোর্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। কালের পরিক্রমায় ১৮৭৫ সালে স্থাপিত হয় ঢাকা মেডিকেল স্কুল। মিডফোর্ড হাসপাতালের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে এই মেডিকেলে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের অধ্যয়ন চলমান থাকে। ১৯৬২ সালে স্কুলটিকে কলেজে রূপান্তর করা হয়। নামকরণ করা হয় ‘মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজ’। পরবর্তীতে নাম বদলে রাখা হয় ‘স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ’। বর্তমানে হাসপাতাল ও কলেজ মিলে পূর্ণ নাম ‘স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল’। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা বুয়েটের শুরু ১৮৭৬ সালে ঢাকা সার্ভে স্কুলের মাধ্যমে। ১৯০২ সালে তৎকালীন সরকার সার্ভে স্কুলকে ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে রূপান্তরের পরিকল্পনা নিলে অর্থাভাবে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছিল না। নওয়াব আহসানুল্লাহ সে সময় ১ লক্ষ ১২ হাজার টাকা দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে তিনি ইন্তেকাল করলে পরবর্তী সময়ে নওয়াব সলিমুল্লাহ সেই অর্থ পরিশোধ করেন। বিদ্যায়তনটির নামকরণ করা হয় ‘আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল’। ১৯৪৭ সালে এটি কলেজে উন্নীত করা হয়। ১৯৬২ সালে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নাম দেওয়া হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়’। মহান মুক্তিযুদ্ধের পরে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’।

আরও পড়ুন  পবিত্র আশুরা আজ

 

ঢাকার সমাজ জীবন পঞ্চায়েত পদ্ধতিকে সুসংগঠিত করার ক্ষেত্রে নওয়াব সলিমুল্লাহর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি খেলাধুলার পৃষ্ঠপোষকতা যেমন করতেন, তেমনি করতেন গান-বাজনা, বায়োস্কোপ প্রদর্শনী, নাট্যাভিনয় প্রভৃতির পৃষ্ঠপোষকতাও। ঈদ, ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহম প্রভৃতি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে গেছেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় জার্মানির খ্যাতিমান আলোকচিত্রী ফ্রিৎজ ক্যাপ ঢাকায় স্টুডিও স্থাপন করেন। স্বনামধন্য সেই আলোকচিত্রীর ছবি ঢাকার অনেক সামাজিক ইতিহাসের সাক্ষী। বঙ্গভঙ্গ রদের ঘটনায় নওয়াব সলিমুল্লাহ দারুণ মর্মাহত হন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে স্থবিরতা আসে। ১৯১৫ সালের ১৬ জানুয়ারি তিনি ইন্তেকাল করেন। মাত্র ৪৪ বছরের জীবনে নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ সর্বভারতীয় পর্যায়ে যতটুকু প্রভাব ফেলতে পেরেছিলেন তা তাঁর উত্তর ও পূর্বপুরুষদের কেউই পারেননি।

 

তথ্য সূত্র
– ঢাকার কয়েকজন মুসলিম সুধী, ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ
– ঢাকার নওয়াব পরিবারের ডায়েরি (১৭৩০-১৯০৩), অনুপম হায়াৎ
– নওয়াব পরিবারের ডায়েরিতে ঢাকার সমাজ ও সংস্কৃতি (১৯০৪-১৯৩০), অনুপম হায়াৎ
– ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এলাকার ইতিহাস (১৫৯৯-২০১২), মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম]

 

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।

সর্বশেষ সংবাদ