সিলেট ১৫ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৩১শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ |
প্রকাশিত: ৯:২৪ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ২৫, ২০২৪
এম. আতিকুর রহমান:
মানুষের মেরুদন্ডের মতো শিক্ষাও একটি জাতির অন্যতম প্রধান অঙ্গ হিসেবে পরিগণিত হয়। শিক্ষার মাধ্যমে জাতি এগিয়ে যায়, উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করে। বোধ-বুদ্ধির বয়স থেকে সবাই শুনে এসেছি শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। আমাদের প্রিয় স্বাধীন জন্মভূমি বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের দিকে ধাবমান। অর্থ বিত্ত চাকচিক্যে বাহ্যিকভাবে উন্নয়ন লক্ষনীয়। সাধারন মানুষের জীবনমান উন্নয়ন আজ সুদূর পরাহত। দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি লুটপাট ক্ষমতার অপব্যবহার চলমান। শোষণ জুলুম নির্যাতন নিপীড়ন নৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয় রীতিমতো গবেষণার বিষয়। দলীয় একক আধিপত্য বিস্তার ও যেনতেন প্রকারে পদ-পদবি এবং ক্ষমতায়নের হিড়িক দৃশ্যমান। আশাবাদি ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আমাদের করণীয় নির্ধারনে উদাসীন।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা জ্ঞানমুখী না হয়ে ক্রমেই সনদমুখী হয়ে পড়ছে। আমাদের বিজ্ঞানচিন্তা, দর্শনচিন্তা সমাজ ও পরিবেশ নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা একটা নির্দিষ্ট মাত্রাতেই আটকে আছে। শিক্ষার মান উন্নত হয় না ভালো শিক্ষক না থাকলে; বইপত্র, শিক্ষা উপকরণ ইত্যাদি মানসম্পন্ন না হলে। শিক্ষাদান ও গ্রহণ আনন্দময় না হলে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার, খেলার মাঠ এসব না থাকলে এবং শ্রেণিকক্ষ উজ্জ্বল ও আরামদায়ক না হলে। আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যে বেতন দিই, তা কোনো মেধাবী শিক্ষার্থীকে শিক্ষকতা পেশার প্রতি আকর্ষিত করবে না। প্রাথমিক শিক্ষকদের যে ‘মর্যাদা’ আমরা দিই, তাতে শিক্ষকতাকে মহান পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার মানুষ পাওয়াও মুশকিল হবে। সিলেবাস ও লিখন-শিখন পদ্ধতির ক্রমাগত পরিবর্তন পরিবর্ধন করার ফলে সংশ্লিষ্ট সম্মানিত শিক্ষকরাই হিমসিম খাচ্ছেন। পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা, লেখা পড়ার গুরুত্ব, ক্লাস নিয়মিত করণ পাঠ্য বইপুস্তক ক্রয়/সংগ্রহ করে নোট তৈরির প্রয়োজনীতা যেন ফুরিয়ে যাচ্ছে। ফলে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, করোনার দুই বছরে দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের অন্তত ১৫ শতাংশ শিশু শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ঝরে গেছে। এই শিশুদের বেশিরভাগই দরিদ্র ও প্রান্তিক পর্যায়ের। পরিবারের আয় কমে যাওয়ায় এবং মূল্যস্ফীতির কারণে বাল্যবিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে কয়েক হাজার কন্যাশিশুকে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই চিত্র মিলেছে। এতে দেখা গেছে, ২০২১ ও ২০২২ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের প্রায় সাড়ে ৯ লাখ শিশু আর বিদ্যালয়েই আসছে না। তাদের প্রায় সবাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান, যার অর্ধেকই আবার কন্যাশিশু। করোনাকালে পরিবারের আয় কমে যাওয়ায় অভিভাবকরা অনেকটা বাধ্য হয়েই তাদের শ্রমঘন কাজে সংযুক্ত করেছেন। আর কন্যাশিশুদের বড় একটা অংশেরই বাল্যবিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারোনার জের কাটতে না কাটতেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধে যুক্ত হয়েছে নতুন ‘বিষফোঁড়’। শুধু ছুটি আর ছুটি। সপ্তাহে দু’দিন বন্ধ। রমজান মাস উপলক্ষে ছুটি, দুই ঈদ উপলক্ষে ছুটি, এখন আবার গরমের ছুটি। গ্রীষ্মের ছুটি, আম কাঠাঁলের ছুটি, শিক্ষা সফর নামে ছুটি, জাতীয় দিবসের ছুটি, বিভিন্ন পূজা পার্বণের ছুটি, বড়দিনের ছুটি, বৌদ্ধপূর্ণিমার ছুটি, আরো কতো নামে বেনামের ছুটি। একটু হিসেব করে দেখেন স্কুল কলেজ মাদ্রাসা খোলা থাকে কয়দিন ??
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ডিজিটাল ডিভাইসের প্রতি শিক্ষার্থীদের আসক্তি, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম, শিশু নির্যাতন, সাইবার বুলিং এমনকি যৌন হয়রানির ঘটনাও বাড়ছে। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস মহামারিতে বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত চার কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশুরা বেড়ে ওঠার জন্য বাহ্যিক পরিবেশ পায় না। তাদের পৃথিবীটা অনেক ছোটো হয়ে যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে না পারায় শিশুরা কারও সঙ্গে মিশতে পারছে না, খেলাধুলা করতে পারছে না। এটি তাদের বেড়ে ওঠাকে প্রভাবিত করছে এবং তাদেরকে এক ধরনের অন্তর্মুখী মানুষ হিসেবে তৈরি করছে। তাদের অন্যান্য সুকুমার বৃত্তির চর্চায়ও প্রভাব বিস্তার করছে। আবার শিশুরা গৃহবন্দী থাকার কারণে, স্কুলে না যাওয়ার কারণে, খেলার সাথী ও খেলাধুলা বঞ্চিত হওয়ার কারণে, স্কুলের বন্ধুদের সাথে মিশতে না পারার কারণে, তাদের মধ্যে নেতিবাচক ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে তারা ভায়োলেন্ট হয়ে উঠছে, হয়ে পড়ছে ডিপ্রেসেড ও মনমরা, বাড়ছে মানসিক সমস্যা।
বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে বন্ধুদের সাথে সামাজিক যোগাযোগের নিষেধাজ্ঞার কারণে ও অনির্দিষ্টকালীন স্কুল বন্ধের কারণে অল্পবয়সী কোমলমতি শিশুরা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে, যা ইতোমধ্যে পরিবারগুলোতে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ঘরবন্দি থাকতে থাকতে তাদের মধ্যে আচরণজনিত সমস্যা হচ্ছে, ঘুমের সময় পরিবর্তন হচ্ছে। বাবা-মা মানসিকভাবে চাপ অনুভব করছেন এবং সেই চাপ শিশুদের মধ্যে সংক্রমিত হচ্ছে। অতিরিক্ত ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারের ফলে শিক্ষার্থীদের মানসিক অবসাদ বাড়ছে। ক্লাস বন্ধ তাতে কী আছে ‘অনলাইন ক্লাস’। এ আরেক আধুনিক অভিশাপ। সারাক্ষণ মোবাইল কিংবা কম্পিউটারে চোখ রেখে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করছে। এটি মা-বাবার জন্য এখন বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনলাইনে লেখাপড়া কতটুকু হয়, তা বিচার করার চেয়ে এখন তাদের এতে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা ভেবে দেখা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক ক্লাস করার নাম নিয়ে সারা দিন তারা অনলাইন ঘাঁটছে, কোনো বাধানিষেধ কাজ করছে না। অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান এবং বিভিন্ন পর্যালোচনা বলছে, এই শিশুশিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্বজনদের বিচ্ছিন্নতাও বাড়ছে। সমস্যা নিয়ে মতবিনিময় কমে যাচ্ছে। বাবা-মায়েরা দেখছেন, এদের অনেকেই কঠিন মানসিক ও শারীরিক অবসাদে ভুগছে। উদ্বিগ্ন থাকছে। এমনকি পড়াশোনায় একাগ্র মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলছে। ‘বেকার মস্তিষ্ক শয়তানের বাসা’ এ গুরুত্বপূর্ণ উক্তিটি বারে বারে প্রণিধানযোগ্য। বিপুল অবসর সময় পেয়ে শিক্ষার্থীদের অনেকেই নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভেবে দেখা উচিত। এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে জাতিকে রক্ষা করতে হবে। নয়তো আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম গভীর তিমির অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে।
সম্পাদক : কবীর আহমদ সোহেল
নির্বাহী সম্পাদক: মোঃ আব্দুল হক
ঢাকা অফিস : ২৩৪/৪ উত্তর গোড়ান, খিলগাঁও, ঢাকা ।
সম্পাদক কর্তৃক প্রগতি প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং লিঃ, ১৪৯ আরামবাগ, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।
সিলেট অফিস: ২৩০ সুরমা টাওয়ার (৩য় তলা)
ভিআইপি রোড, তালতলা, সিলেট।
মোবাইল-০১৭১২-৫৯৩৬৫৩, ০১৭১২-০৩৩৭১৫
E-mail: provatbela@gmail.com,
কপিরাইট : দৈনিক প্রভাতবেলা.কম
আমাদের সর্ম্পকে গোপনীয়তা যোগাযোগ
Design and developed by ওয়েব হোম বিডি